
চিকিৎসা-সংকট - ৩
নিধু বলিলー ‘কি দাদা, বোকরেজির সাধ মিট্ল?
গুপী। নাঃ এ-সব বাজে চিকিৎসার কাজ নয়। কোথাও চেঞ্জে চল। বঙ্কু। আমি বলি কি, নন্দ বে-থা ক’রে ঘরে পরিবার আনুক ৷ এ-রকম দামড়া হয়ে থাকা কিছু নয়।
নন্দ চিঁ চিঁ স্বরে বলিলেন ‘আর পরিবার। কোন্ দিন আছি, কোন্ দিন নেই। এই বয়সে একটা কচি বউ এনে মিথ্যে জঞ্জাল জোটানো।’
নিধু বলিল ‘নন্-দা, একটা মোটর কেন মাইরি। দু-দিন হাওয়া খেলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। সেভেন সিটার হডসন; ষেটের কোলে আমরা তো পাঁচজন আছি।’
ষষ্ঠী। তা যদি বললে, তবে আমার মতে মোটর-কারও যা, পরিবারও তা। ঘরে আনা সোজা, কিন্তু মেরামতী খরচ যোগাতে প্রাণান্ত৷ আজ টায়ার ফাল, কাল গিন্নীর অম্বলশূল, পরশু ব্যাটারি খারাপ, তরশু ছেলেটার ঠাণ্ডা লেগে জ্বর। অমন কাজ ক’রো না নন্দ। জেরবার হবে। এই শীতকালে কোথা দু-দণ্ড লেপের মধ্যে ঘুমুব মশায়, তা নয়, সারারাত প্যান প্যান ট্যা ট্যা।
নিধু। ষষ্ঠী খুড়ো যে রকম হিসেবী লোক, একটি মোটাসোটা রোঁ-ওলা ভাল্লুকের মেয়ে বে করলে ভাল করতেন। লেপকম্বলের খরচা বাঁচত৷
গুপী। যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন৷ কাল সকালে নন্দ একবার হাকিম সাহেবের কাছে যাও। তার পর যা হয় করা যাবে।
নন্দবাবু অগত্যা রাজী হইলেন ৷
হাজিক-উল-মুল্ক্ বিন লোকমান নুরুল্লা গজন ফরুল্লা অল হকিম য়ুনানী লোয়ার চিৎপুর রোডে বাসা লইয়াছেন। নন্দবাবু তেতলায় উঠিলে একজন লুঙ্গি-পরা ফেজ-ধারী লোক তাঁহাকে বলিল ‘আসেন বাবু-মশায়। আমি হাকিম সাহেবের মীরমুন্সী। কি বেমারি বোলেন, আমি লিখে হুজুরকে ইতালা ভেজিয়ে দিব।’
নন্দ। বেমারি কি সেটা জানতেই তো আসা বাপু।
মুন্সী। তব্ ভি কুছু তো বোলেন। না-তাকৃতি, বুখার, পিল্লি, চেচক, ঘেঘ, বাওআসির, রাত-অন্ধিー
নন্দ। ও-সব কিছু বুঝলুম না বাপু। আমার প্রাণটা ধফড় করছে।
মুন্সী। সো হি বোলেন৷ দিল তড়পনা। মোহর এনেছেন? নন্দ। মোহর ? মুন্সী। হাকিম সাহেব চাঁদি ছোন না। নজরানা দো মোহর৷ না থাকে আমি দিচ্ছি। পয়তালিশ টাকা, আর বাট্টা দো টাকা আর রেশমী রুমাল দো টাকা। দরবারে যেয়ে আগে হুজুরকে বন্দগি জনাব বোলবেন, তার পর রুমালের ওপর মোহর রেখে সামনে ধরবেন।
মুন্সী নন্দবাবুকে তালিম দিয়া দরবারে লইয়া গেল৷ একটি বৃহৎ ঘরে গালিচা পাতা, একপার্শ্বে মসনদের উপর তাকিয়া হেলান দিয়া হাকিম সাহেব ফরসিতে ধুমপান করিতেছেন। বয়স পঞ্চান্ন, বাবরী চুল, গোঁফ খুব ছোট করিয়া ছাঁটা। আবক্ষলম্বিত দাড়ির গোড়ার দিক সাদা, মধ্যে লাল, ডগায় নীল। পরিধান সাটিনের চুড়িদার ইজার, কিংখাপের জোব্বা, জরির তাজ। সম্মুখে ধূপদানে মুসব্বর এবং রুমী মস্তগি জ্বলিতেছে, পাশে পিকদান, পানদান, আতরদান ইত্যাদি। চার- পাঁচজন পারিষদ হাঁটু মুড়িয়া বসিয়া আছে এবং হাকিমের প্রতি কথায় ‘কেরামত’ বলিতেছে। ঘরের কোণে একজন ঝাঁকড়া চুলো চাপ-দেড়ে লোক সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং এবং বিকট অঙ্গভঙ্গী করিতেছে।
নন্দবাবু অভিবাদন করিয়া মোহর নজর দিলেন। হাকিম ঈষৎ হাসিয়া আতরদান হইতে কিঞ্চিৎ তুলা লইয়া নন্দর কানে গুজিয়া দিলেন। মুন্সী বলিল ‘আপনি বাংলায় বাতচিত বোলেন। হামি হুজুরকে সম্ঝিয়ে দিব।’
নন্দবাবুর ইতিবৃত্ত শেষ হইলে হাকিম ঋষভকণ্ঠে বলিলেন ー ‘সর্ লাও।’
নন্দ শিহরিয়া উঠিলেন। মুন্সী আশ্বাস দিয়া বলিল ー ‘ডরবেন না মশয়। জনাবকে আপনার শির দেখলান।’
নন্দর মাথা টিপিয়া হাকিম বলিলেন ー ‘ইড্ডি পিলপিলায় গয়া।’ মুন্সী। শুনেছেন? মাথার হাড় বিলকুল লরম হয়ে গেছে।
হাকিম তিনরঙা দাড়িতে আঙুল চালাইয়া বলিলেন ー ‘সুর্মা সুর্খ।’
একজন একটা লাল গুঁড়া নন্দর চোখের পল্লবে লাগাইয়া দিল। মুন্সী বুঝাইল ‘আঁখ ঠাণ্ডা থাকবে, নিদ হোবে।’ হাকিম আবার বলিলেন ー ‘রোগন বব্বর।’ মুন্সী হাঁকিল ー ‘এ জী বালবর, অস্তরা লাও।’ নন্দবাবু ー ‘হাঁ-হাঁ আরে তুম করো কি ー বলিতে বলিতে নাপিত চট্ করিয়া তাঁহার ব্রহ্মতালুর উপর ছ-ইঞ্চি সমচতুষ্কোণ কামাইয়া দিল, আর একজন তাহার উপর একটা দুর্গন্ধ প্রলেপ লাগাইল। মুন্সী বলিলー ‘ঘব্ড়ান কেন মশয়, এ হচ্চে বব্বরী সিংগির মাথার ঘি। বহুত কিম্মত। মাথার হাড্ডি সকত হোবে।’ নন্দবাবু কিয়ৎক্ষণ হতভম্ব অবস্থায় রহিলেন। তার পর প্রকৃতিস্থ হইয়া বেগে ঘর হইতে পলায়ন করিলেন। মুন্সী পিছনে ছুটিতে ছুটিতে বলিল – ‘হামার দস্তুরি?’ নন্দ একটা টাকা ফেলিয়া দিয়া তিন লাফে নীচে নামিয়া গাড়িতে উঠিয়া কোচমানকে বলিলেন – ‘হাঁকাও!’
সন্ধ্যাকালে বন্ধুগণ আসিয়া দেখিলেন বৈঠকখানার দরজা বন্ধ। চাকর বলিল, বাবুর বড় অসুখ, দেখা হইবে না। সকলে বিষণ্নচিত্তে ফিরিয়া গেলেন।
সমস্ত রাত বিছানায় ছটফট করিয়া ভোর চারটার সময় নন্দবাবু ভীষণ প্রতিজ্ঞা করিলেন যে আর বন্ধুগণের পরামর্শ শুনিবেন না, নিজের ব্যবস্থা নিজেই করিবেন।
বেলা আটটার সময় নন্দ বাড়ি হইতে বাহির হইলেন এবং বড়-রাস্তায় ট্যাক্সি ধরিয়া বলিলেন – ‘সিধা চলো।’ সংকল্প করিয়াছেন, মিটারে এক টাকা উঠিলেই ট্যাক্সি হইতে নামিয়া পড়িবেন, এবং কাছাকাছি যে চিকিৎসক পান তাহারই মতে চলিবেন তা সে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ, হাতুড়ে, অবধূত, মাদ্ৰাজী বা চাঁদসির ডাক্তার যেই হউক।
বউবাজারে নামিয়া একটি গলিতে ঢুকিতেই সাইন-বোর্ড নজরে পড়িল ‘ডাক্তার মিস বি. মল্লিক।’ নন্দ-বাবু ‘মিস’ শব্দটি লক্ষ্য করেন নাই, নতুবা হয়তো ইতস্তত করিতেন। একবারে সোজা পরদা ঠেলিয়া একটি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
মিস বিপুলা মল্লিক তখন বাহিরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া কাঁধের উপর সেফটি পিন আঁটিতে-ছিলেন। নন্দকে দেখিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন – ‘কি চাই আপনার?’
নন্দবাবু প্রথমটা অপ্রস্তুত হইলেন, তার পর মরিয়া হইয়া ভাবিলেন দূর হ’ক, না হয় লেডি ডাক্তারের পরামর্শই নেব। বলিলেন ‘বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি।’ মিস্ মল্লিক। পেন আরম্ভ হয়েছে?
নন্দ৷ পেন তো কিছু টের পাচ্ছি না।
মিস্। ফার্স্ট কনফাইনমেণ্ট?
নন্দ। আজ্ঞে ?
মিস্। প্রথম পোয়াতী?
নন্দ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন – ‘আমি নিজের চিকিৎসার জন্যই এসেছি।’
মিস মল্লিক আশ্চর্য হইয়া বলিলেন – ‘নিজের জন্যে? ব্যাপার কি?’
সমগ্র ইতিহাস বর্ণনা শেষ হইলে মিস মল্লিক নন্দবাবুর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দু-চারিটি প্রশ্ন করিয়া কহিলেন – ‘আপনার নামটি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?’
নন্দ। শ্রীনন্দদুলাল মিত্র।
মিস। বাড়িতে কে আছেন ?
নন্দ জানাইলেন তিনি বহুদিন বিপত্নীক, বাড়িতে এক বৃদ্ধা পিসী ছাড়া কেউ নাই ৷
মিস। কাজকর্ম কি করা হয়?
নন্দ। তা কিছু করি না। পৈতৃক সম্পত্তি আছে।
মিস। মোটর-কার আছে?
নন্দ। নেই তবে কেনবার ইচ্ছে আছে।
মিস মল্লিক আরও নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়া কিছুক্ষণ ঠোঁটে হাত দিয়া চিন্তা করিলেন, তার পর ধীরে ধীরে বামে দক্ষিণে ঘাড় নাড়িলেন।
নন্দ ব্যাকুল হইয়া বলিলেন – ‘দোহাই আপনার, সত্যি ক’রে বলুন আমার কি হয়েছে। টিউমার, না পাথুরি, না উদরী, না কালাজ্বর, না হাইড্রোফোবিয়া?’ মিস মল্লিক হাসিয়া বলিলেন – ‘কেন আপনি ভাবছেন? ও-সব কিছুই হয় নি। আপনার শুধু একজন অভিভাবক দরকার।’
নন্দ অধিকতর কাতর কণ্ঠে বলিলেন – ‘তবে কি আমি পাগল হয়েছি?’ মিস মল্লিক মুখে রুমাল দিয়া খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিলেন – ‘ও ডিয়ার ডিয়ার নো। পাগল হবেন কেন? আমি বলছিলুম, আপনার যত্ন নেবার জন্যে বাড়িতে উপযুক্ত লোক থাকা দরকার।’
নন্দ। কেন পিসীমা তো আছেন।
মিস মল্লিক পুনরায় হাসিয়া বলিলেন – ‘দি আইডিয়া! মাসী-পিসীর কাজ নয়। যাক, আপাতত একটা ওষুধ দিচ্ছি, খেয়ে দেখবেন। বেশ মিষ্টি, এলাচের গন্ধ। এক হপ্তা পরে আবার আসবেন’
নন্দবাবু সাত দিন পরে পুনরায় মিস বিপুলা মল্লিকের কাছে গেলেন। তার পর দু-দিন পরে আবার গেলেন। তার পর প্রত্যহ। তার পর একদিন নন্দবাবু পিসীমাতাকে কাশীধামে রওনা করাইয়া দিয়া মস্ত বাজার করিলেন। এক ঝুড়ি গলদা চিংড়ি, এক ঝুড়ি মটন, তদনুযায়ী ঘি, ময়দা, দই, সন্দেশ ইত্যাদি। বন্ধুবর্গ খুব খাইলেন। নন্দবাবু জরিপাড় সূক্ষ্ম ধুতির উপর সিল্কের পাঞ্জাবি পরিয়া সলজ্জ সস্মিতমুখে সকলকে আপ্যায়িত করিলেন।
মিসেস বিপুলা মিত্র এখন আর স্বামী ভিন্ন অপর রোগীর চিকিৎসা করেন না। তবে নন্দবাবু ভালই আছেন। মোটর-কার কেনা হইয়াছে। দুঃখের বিষয়, সান্ধ্য আড্ডাটি ভাঙিয়া গিয়াছে।