
চিকিৎসা-সংকট - ২
পরদিন খুব ভোরে নন্দবাবু নেপাল ডাক্তারের বাড়ি আসিলেন। রোগীর ভিড় এখনও আরম্ভ হয় নাই, অল্পক্ষণ পরেই তাঁর ডাক পড়িল। একটি প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেতে ফরাশ পাতা। চারিদিকে স্তূপাকারে বহি সাজানো। বহির দেওয়ালের মধ্যে গল্পবর্ণিত শেয়ালের মত বৃদ্ধ নেপালবাবু বসিয়া আছেন। মুখে গড়গড়ার নল, ঘরটি ধোঁয়ায় ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।
নন্দবাবু নমস্কার করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন৷ নেপাল ডাক্তার কটমট দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন ‘বসবার জায়গা আছে।’ নন্দ বসিলেন।
নেপাল। শ্বাস উঠেছে?
নন্দ। আজ্ঞে?
নেপাল। রুগীর শেষ অবস্থা না হ’লে তো আমায় ডাকা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করছি।
নন্দ সবিনয়ে জানাইলেন তিনিই রোগী ।
নেপাল। অ্যালোপ্যাথ ডাকাত ব্যাটারা ছেড়ে দিলে যে বড়? তোমার হয়েছে কি? নন্দবাবু তাঁহার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করিলেন।
নেপাল। তফাদার কি বলেছে?
নন্দ। বললেন আমার মাথায় টিউমার আছে। নেপাল। তফাদারের মাথায় কি আছে জান? গোবর। আর টুপির ভেতর শিং, জুতোর ভেতর খুর, পাতলুনের ভেতর ল্যাজ। খিদে হয়?
নন্দ। দু-দিন থেকে একেবারে হয় না।
নেপাল। ঘুম হয়?
নন্দ। না। নেপাল। মাথা ধরে?
নন্দ। কাল সন্ধ্যেবেলা ধরেছিল। নেপাল। বাঁ দিক ?
নন্দ। আজ্ঞে হাঁ ।
নেপাল। না ডান দিক ? নন্দ। আজ্ঞে হাঁ ।
নেপাল ধমক দিয়া বলিলেন – ‘ঠিক ক’রে বল।’
নন্দ। আজ্ঞে ঠিক মধ্যিখানে।
নেপাল। পেট কামড়ায়? নন্দ। সেদিন কামড়েছিল। নিধে কাবলী মটরভাজা এনেছিল তাই খেয়ে।
নেপাল। পেট কামড়ায় না মোচড় দেয় তাই বল ৷
নন্দ বিব্রত হইয়া বলিলেন – ‘হাঁচোড়-পাঁচোড় করে।’ ডাক্তার কয়েকটি মোটা-মোটা বহি দেখিলেন, তার পর অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন – হুঁ। একটা ওষুধ দিচ্ছি নিয়ে যাও। আগে শরীর থেকে অ্যালোপ্যাথিক বিষ তাড়াতে হবে। পাঁচ বছর বয়সে আমায় খুনে ব্যাটারা ছ-গ্রেন কুইনীন দিয়েছিল, এখনও বিকেলে মাথা টিপ টিপ করে। সাতদিন পরে ফের এসো। তখন আসল চিকিৎসা শুরু হবে।’ নন্দ। ব্যারামটা কি আন্দাজ করছেন?
ডাক্তার ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন – ‘তা জেনে তোমার চারটে হাত বেরবে নাকি? যদি বলি তোমার পেটে ডিফারেনশ্যাল ক্যাল্কুলস হয়েছে, কিছু বুঝবে? ভাত খাবে না, দু-বেলা রুটি, মাছ-মাংস বারণ, শুধু মুগের ডালের যূষ, স্নান বন্ধ, গরম জল একটু খেতে পার, তামাক খাবে না, ধোঁয়া লাগলে ওষুধের গুণ নষ্ট হবে। ভাবছো আমার আলমারির ওষুধ নষ্ট হয়ে গেছে? সে ভয় নেই, আমার তামাকে সালফার-থার্টি মেশানো থাকে। ফী কত তাও ব’লে দিতে হবে নাকি ? দেখছো না দেওয়ালে নোটিস লটকানো রয়েছে বত্রিশ টাকা ? আর ওষুধের দাম চার টাকা।’
নন্দবাবু টাকা দিয়া বিদায় লইলেন।
নিধু বলিল – ‘কেন বাওআ কাঁচা পয়হা নষ্ট করছ? থাকলে পাঁচ রাত বক্সে ব’সে ঠিয়াটার দেখা চলত ৷ ও নেপাল-বুড়ো মস্ত ঘুঘু, নন্-দাকে ভালমানুষ পেয়ে জেরা ক’রে থ ক’রে দিয়েছে ৷ পড়ত আমার পাল্লায় বাছাধন, কত বড় হোমিওফাঁক দেখে নিতুম ৷ এক চুমুকে তার আলমারি-শুদ্ধ ওষুধ সাবড়ে না দিতে পারি তো আমার নাক কেটে দিও।’
গুপী। আজ আপিসে শুনছিলুম কে একজন বড় হাকিম ফরক্কাবাদ থেকে এখানে এসেছে। খুব নামডাক, রাজা-মহারাজারা সব চিকিৎসা করাচ্ছে । একবার দেখালে হয় না?
ষষ্ঠী। এই শীতে হাকিমী ওষুধ ? বাপ, শরবত খাইয়েই মারবে। তার চেয়ে তারিণী কোবরেজ ভাল।
অতঃপর কবিরাজী চিকিৎসাই সাব্যস্ত হইল।
পরদিন সকালে নন্দবাবু তারিণী কবিরাজের বাড়ি উপস্থিত হইলেন। কবিরাজ মহাশয়ের বয়স ষাট, ক্ষীণ শরীর, দাড়ি-গোঁফ কামানো৷ তেল মাখিয়া আট- হাতী ধুতি পরিয়া একটি চেয়ারের উপর উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছেন। এই অবস্থাতেই ইনি প্রত্যহ রোগী দেখেন। ঘরে একটি তক্তাপোশ, তাহার উপর তেলচিটে পাটি এবং কয়েকটি মলিন তাকিয়া। দেওয়ালের কোলে দুটি ঔষধের আলমারি।
নন্দবাবু নমস্কার করিয়া তক্তাপোশে বসিলে কবিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেনー ‘বাবুর কনথে আসা হচ্চে?’ নন্দবাবু নিজের নাম ও ঠিকানা বলিলেন।
তারিণী। রুগীর ব্যামোডা কি?
নন্দবাবু জানাইলেন তিনি রোগী এবং সমস্ত ইতিহাস বিবৃত করিলেন।
তারিণী। মাথার খুলি ছেদা করে দিয়েছে নাকি?
নন্দ৷ আজ্ঞে না, নেপালবাবু বললেন পাথুরি, তাই আর মাথায় অস্তর করাই নি।
তারিণী। নেপাল! সে আবার কেডা?
নন্দ৷ জানেন না? চোরবাগানের নেপালচন্দ্র রায় M. B. F. T. S. - মস্ত হোমিওপ্যাথ৷
তারিণী। অঃ, ন্যাপলা, তাই কও। সেডা আবার ডাগদর হ’ল কবে? বলি, পাড়ায় এমন বিচক্ষণ কোবরেজ থাকতি ছেলে-ছোকরার কাছে যাও কেন?
নন্দ। আজ্ঞে, বন্ধু-বান্ধবরা বললে ডাক্তারের মতটা আগে নেওয়া দরকার, যদিই অস্ত্রচিকিৎসা করতে হয়।
তারিণী। জন্তিবাবু-রি চেন? খুলনের উকিল যন্তিবাবু? নন্দ ঘাড় নাড়িলেন।
তারিণী। তাঁর মামার হয় উরুস্তম্ভ। সিভিল সার্জন পা কাটলে। তিন দিন অচৈতন্য। জ্ঞান হলি পর কইলেন, আমার ঠ্যাং কই? ডাক্ তারিণী-স্যানরে। দেলাম ঠুকে এক দলা চ্যাবনপ্রাশ। তারপর কি হ’ল কও দিকি?
নন্দ ৷ আবার পা গজিয়েছে বুঝি ?
‘ওরে অ ক্যাবলা, দেখ, দেখ, বিড়েলে সবড়া ছাগ-লাদ্য ঘ্রেত খেয়ে গেল’ – বলিতে বলিতে কবিরাজ মহাশয় পাশের ঘরে ছুটিলেন। একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া যথাস্থানে বসিয়া বলিলেন ‘দ্যাও নাড়ীডা একবার দেখি। হঃ, যা ভাবছিলাম তাই। ভারী ব্যামো হয়েছিল কখনও?’
নন্দ। অনেক দিন আগে টাইফয়েড হয়েছিল।
তারিণী। ঠিক ঠাউরেচি। পাচ বছর আগে?
নন্দ। প্রায় সাড়ে সাত বছর হ’ল।
তারিণী। একই কথা, পাচ দেরা সারে সাত। প্রাতিক্কালে বোমি হয়?
নন্দ। আজ্ঞে না।
তারিণী। হয়, zানতি পার না। নিদ্ৰা হয়?
নন্দ। ভাল হয় না ৷
তারিণী। হবেই না তো। উর্ধু হয়েছে কি না। দাত কনকন করে ?
নন্দ। আজ্ঞে না না।
তারিণী। করে, zানতি পার না। যা হোক, তুমি চিন্তা কোরো নি বাবা। আরাম হয়ে যাবানে। আমি ওষুধ দিচ্চি।
কবিরাজ মহাশয় আলমারি হইতে একটা শিশি বাহির করিলেন, এবং তাহার মধ্যস্থিত বড়ির উদ্দেশ্যে বলিলেন ‘লাফাস নে, থাম্ থাম্। আমার সব জীয়ন্ত ওষুধ, ডাকলি ডাক শোনে। এই বড়ি সকাল-সন্ধ্য একটা করি খাবা৷ আবার তিনদিন পরে আসবা। বুজেচ?
নন্দ৷ ‘আজ্ঞে হাঁ৷’
তারিণী। ছাই বুজেচ। অনুপান দিতি হবে না? ট্যাবা লেবুর রস আর মধুর সাথি মাড়ি খাবা৷ ভাত খাবা না। ওলসিদ্ধ, কচুসিদ্ধ এইসব খাবা। নুন ছোবা না। মাগুর মাছের ঝোল একটু চ্যানি দিয়ে রাঁধি খাতি পার। গরম জল ঠাণ্ডা করি খাবা।
নন্দ। ব্যারামটা কি ?
তারিণী। যারে কয় উদুরি। উর্ধুশ্লেষ্মাও কইতি পার।
নন্দবাবু কবিরাজের দর্শনী ও ঔষধের মূল্য দিয়া বিমর্ষচিত্তে বিদায় লইলেন।