Pitara logo

চিকিৎসা-সংকট - ১

সন্ধ্যা হব হব। নন্দবাবু হগ সাহেবের বাজার হইতে ট্রামে বাড়ি ফিরিতেছেন। বীডন স্ট্রীট পার হইয়া গাড়ি আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল। সম্মুখে গরুর গাড়ি। আর একটু গেলেই নন্দবাবুর বাড়ির মোড় ৷ এমন সময় দেখিলেন পাশের একটি গলি হইতে তাঁর বন্ধু বংকু বাহির হইতেছেন। নন্দবাবু উৎফুল্ল হইয়া ডাকিলেন – দাড়াও হে বংকু, আমি নাবছি।’ নন্দর দু-বগলে দুই বাণ্ডিল, ব্যস্ত হইয়া চলন্ত গাড়ি হইতে যেমন নামিবেন অমনি কোঁচায় পা বাধিয়া নীচে পড়িয়া গেলেন । গাড়িতে একটা শোরগোল উঠিল এবং ঘ্যাচাং করিয়া গাড়ি থামিল ৷ জনকতক যাত্রী নামিয়া নন্দকে ধরিয়া তুলিলেন। যাঁরা গাড়ির মধ্যে ছিলেন তাঁরা গলা বাড়াইয়া নানাপ্রকারে সমবেদনা জানাইতে লাগিলেন । – আহা হা বড্ড লেগেছে – থোড়া গরম দুধ পিলা দোও – দুটো পা-ই কি কাটা গেছে ?’ একজন সিদ্ধান্ত করিল মৃগি। আর একজন বলিল ভির্মি I কেউ বলিল মাতাল, কেউ বলিল বাঙাল, কেউ বলিল পাড়াগেঁয়ে ভূত৷ বাস্তবিক নন্দবাবুর মোটেই আঘাত লাগে নাই ৷ কিন্তু কে তা শোনে । ‘লাগে নি কি মশায়, খুব লেগেছে – দু-মাসের ধাক্কা – বাড়ি গিয়ে টের পাবেন।’ নন্দ বার বার করজোড়ে নিবেদন করিলেন যে প্রকৃতই তাঁর কিছুমাত্র চোট লাগে নাই। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলিলেন ‘আরে মোলো, ভাল করলে মন্দ হয়। পষ্ট দেখলুম লেগেছে তবু বলে লাগে নি।’

এমন সময় বঙ্কুবাবু আসিয়া পড়ায় নন্দবাবু পরিত্রাণ পাইলেন, মনঃক্ষুন্ন যাত্রিগণসহ ট্রাম গাড়িও ছাড়িয়া গেল।

বংকু বলিলেন ‘মাথাটা হঠাং ঘুরে গিয়েছিল আর কি। যা হোক, বাড়ির পথটুকু আর হেঁটে গিয়ে কাজ নেই । এই রিক্শ 一’

রিক্শ নন্দবাবুকে আস্তে আস্তে লইয়া গেল, বংকু পিছনে হাঁটিয়া চলিলেন।

নন্দবাবুর বয়স চল্লিশ, শ্যামবর্ণ, বেঁটে গোলগাল চেহারা। তাঁহার পিতা পশ্চিমে কমিসারিয়টে চাকরি করিয়া বিস্তর টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যু-কালে একমাত্র সন্তান নন্দর জন্য কলিকাতায় একটি বড় বাড়ি, বিস্তর আসবাব এবং মস্ত এক গোছা কোম্পানির কাগজ রাখিয়া যান। নন্দর বিবাহ অল্পবয়সেই হইয়াছিল, কিন্তু এক বৎসর পরেই তিনি বিপত্নীক হন এবং তার পর আর বিবাহ করেন নাই । মাতা বহুদিন মৃতা, বাড়িতে একমাত্র স্ত্রীলোক এক বৃদ্ধা পিসী । তিনি ঠাকুরসেবা লইয়া বিব্রত, সংসারের কাজ ঝি চাকররাই দেখে। নন্দবাবুর দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে আপত্তি নাই, কিন্তু এ পর্যন্ত তাহা হইয়া উঠে নাই। প্রধান কারণ – আলস্য। থিয়েটার, সিনেমা, ফুটবল ম্যাচ, রেস এবং বন্ধুবর্গের সংসর্গ – ইহাতে নির্বিবাদে দিন কাটিয়া যায়, বিবাহের ফুরসত কোথা ? তার পর ক্রমেই বয়স বাড়িয়া যাইতেছে, আর এখন না করাই ভাল। মোটের উপর নন্দ নিরীহ গোবেচারা অল্পভাষী উদ্যমহীন আরামপ্রিয় লোক ৷

নন্দবাবুর বাড়ির নীচে সুবৃহৎ ঘরে সান্ধ্য আড্‌ডা বসিয়াছে। নন্দ আজ কিছু ক্লান্ত বোধ করিতেছেন, সেজন্য বালাপোশ গায়ে দিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া আছেন। বন্ধুগণের চা ও পাঁপর ভাজা শেষ হইয়াছে, এখন পান সিগারেট ও গল্প চলিতেছে।

গুপীবাবু বলিতেছিলেন — ‘উহু। শরীরের ওপর এত অযত্ন ক’রো না নন্দ ৷ এই শীতকালে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ভাল লক্ষণ নয়।’

নন্দ । মাথা ঠিক ঘোরেনি, কেবল কোঁচার কাপড় বেধে –

গোপী৷ আরে, না না। ঘুরেছিল বইকি। শরীরটা কাহিল হয়েছে। এই তো কাছাকাছি ডাক্তার তফাদার রয়েছেন। অত বড় ফিজিশিয়ান আর শহরে পাবে কোথা? যাও না কাল সকালে একবার তাঁর কাছে।

বংকু বলিলেন – ‘আমার মতে একবার নেপালবাবুকে দেখালেই ভাল হয়। অমন বিচক্ষণ হোমিওপ্যাথ আর ছুটি নেই। মেজাজটা একটু তিরিক্ষি বটে, কিন্তু বুড়োর বিদ্যে অসাধারণ।

ষষ্ঠীবাবু মুড়িশুড়ি দিয়া এক কোনে বসিয়াছিলেন । তাঁর মাথায় বালাক্লাভা টুপি, গলায় দাড়ি এবং তার উপর কম্ফর্টার। বলিলেন ‘বাপ, এই শীতে অবেলায় কখনও ট্রামে চড়ে? শরীর অসাড় হ’লে আছাড় খেতেই হবে। নন্দর শরীর একটু গরম রাখা দরকার।

নিধু বলিল ‘নন্-দা, মোটা চাল ছাড়। সেই এক বিরিঞ্চির আমলের ফরাস তাকিয়া, লক্কড় পালকি গাড়ি আর পক্ষিরাজ ঘোড়া, এতে গায়ে গত্তি লাগবে কিসে? তোমার পয়হার অভাব কি বাওআ ? একটু ফুর্তি করতে শেখ।’

সাব্যস্ত হইল কাল সকালে নন্দবাবু ডাক্তার তফাদারের বাড়ি যাইবেন।

ডাক্তার তফাদার M.D, M. R.A.S. গ্রে স্ট্রীটে থাকেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, দু-খানা মোটর, একটা ল্যাণ্ড। খুব পসার, রোগীরা ডাকিয়া সহজে পায় না৷ দেড় ঘণ্টা পাশের কামরায় অপেক্ষা করার পর নন্দবাবুর ডাক পড়িল। ডাক্তার-সাহেবের ঘরে গিয়া দেখিলেন এখনও একটি রোগীর পরীক্ষা চলিতেছে। একজন স্থূলকায় মারোয়াড়ী নগ্নগাত্রে দাড়াইয়া আছে। ডাক্তার ফিতা দিয়া তাহার ভুঁড়ির পরিধি মাপিয়া বলিলেন – ‘বস্, সওয়া ইঞ্চি বঢ়, গিয়া।’ রোগী খুশী হইয়া বলিল – ‘নবজ তো দেখিয়ে।’ ডাক্তার রোগীর মণিবন্ধে নাড়ীর উপর একটি মোটর-কারের স্পার্কিং প্লাগ ঠেকাইয়া বলিলেন “বহুত মজেসে চল্ রহা।’ রোগী বলিল ‘জবান তো দেখিয়ে।’ রোগী হাঁ করিল, ডাক্তার ঘরের অপর দিকে দাঁড়াইয়া অপেরা গ্লাস দ্বারা তাহার জিব দেখিয়া বলিলেন ‘থোড়েসি কসর হ্যায় কল্ ফিন আনা।’

রোগী চলিয়া গেলে তফাদার নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন – ‘ওয়েল?’

নন্দ বলিলেন – ‘আজ্ঞে বড় বিপদে প’ড়ে আপনার কাছে এসেছি। কাল হঠাৎ ট্রাম থেকে –

তফাদার। কম্পাউণ্ড ফ্রাক্‌চার ? হাড় ভেঙ্গেছে ?

নন্দবাবু আনুপূর্বিক তাঁর অবস্থার বর্ণনা করিলেন। বেদনা নাই, জ্বর হয় না, পেটের অসুখ,সর্দি, হাঁপানি নাই ৷ ক্ষুধা কাল হইতে একটু কমিয়াছে। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছেন ৷ মনে বড় আতঙ্ক ৷

ডাক্তার তাঁহার বুক পেট মাথা হাত পা নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন ‘জিব দেখি।’ নন্দবাবু জিব বাহির করিলেন । ডাক্তার ক্ষণকাল মুখ বাঁকাইয়া কলম ধরিলেন । প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হইলে নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন - ‘আপনি এখন জিব টেনে নিতে পারেন । এই ওষুধ রোজ তিনবার খাবেন।’

নন্দ। কি রকম বুঝলেন?

তফাদার। ভেরি ব্যাড।

নন্দ সভয়ে বলিলেন ‘কি হয়েছে?’

তফাদার। আরও দিন কতক ওয়াচ না করলে ঠিক বলা যায় না। তবে সন্দেহ করছি cerebral tumour with strangulated ganglia। ট্রিফাইন ক’রে মাথার খুলি ফুটো ক’রে অস্ত্র করতে হবে, আর ঘাড় চিরে নার্ভের জট ছাড়াতে হবে। শর্ট-সার্কিট হয়ে গেছে।

নন্দ। বাঁচব তো ?

তফাদার। দমে যাবেন না, তা হ’লে সারাতে পারব না। সাত দিন পরে ফের আসবেন। মাই ফ্রেণ্ড মেজর গোসাইএর সঙ্গে একটা কন্‌সলটেশনের ব্যবস্থা করা যাবে। ভাত-ডাল বড় একটা খাবেন না । এগ-ফ্লিপ, বোনম্যারো সুপ, চিকেন-স্ট্যু এইসব । বিকেলে একটু বার্গণ্ডি খেতে পারেন। বরফ-জল খুব খাবেন। হ্যাঁ, বত্রিশ টাকা। থ্যাঙ্ক ইউ৷

নন্দবাবু কম্পিত পদে প্রস্থান করিলেন । সন্ধ্যাবেলা বংকুবাবু বলিলেন ‘আরে তখনি আমি বারণ করেছিলুম ওর কাছে যেয়ো না। ব্যাটা মেড়োর পেটে হাত বুলিয়ে খায়। এঃ, খুলির ওপর তুরপুন চালাবেন!’

ষষ্ঠীবাবু৷ আমাদের পাড়ার তারিণী কবিরাজকে দেখালে হয় না ? গুপীবাবু। না না, যদি বাস্তবিক নন্দর মাথার ভেতর ওলট-পালট হয়ে গিয়ে থাকে তবে হাতুড়ে বদির কম্ম নয়। হোমিওপ্যাথিই ভাল।

নিধু। আমার কথা তো শুনবে না বাওআ ৷ ডাক্তারি তোমার ধাতে না সয় তো একটু কোবরেজি করতে শেখ। দরওয়ানজী দিব্বি একলোটা বানিয়েছে। বল তো একটু চেয়ে আনি৷

হোমিওপ্যাথিই স্থির হইল।

চিকিৎসা-সংকট - ২