Pitara logo

শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড - ৩

দেড় বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। ব্রহ্মচারী অ্যান্ড ব্রাদার-ইন-ল কোম্পানির আপিসে ডিরেক্টরগণের সভা বসিয়াছে ৷ সভাপতি তিনকড়িবাবু টেবিলে ঘুষি মারিয়া বলিতেছিলেন –’আ–আ–আমি জানতে চাই, টাকা সব গেল কোথা। আমার তো বাড়িতেই টেকা ভার,—— সবাই এসে তাড়া দিচ্ছে। কয়লাওয়ালা বলে তার পঁচিশ হাজার টাকা পাওনা, ইটখোলার ঠিকাদার বলে বারো হাজার, তার পর ছাপাখানাওলা, শার্পার কোম্পানি, কুণ্ড মুখুজ্যে, আরও কত কে আছে। বলে আদালতে যাব। মন্দিরের কোথা কি তার ঠিক নেই – এর মধ্যে দু-লার্থ টাকা ফুঁকে গেল ? সে ভণ্ড জোচ্চোরটা গেল কোথা? শুনতে পাই ডুব মেরে আছে, আপিসে বড়-একটা আসে না।’

অটল। ব্রহ্মচারী বলেন, মা তাঁকে অন্য কাজে ডাকছেন এদিকে আর তেমন মন নেই । আজ তে। মিটিংএ আসবেন বলেছেন ৷

বিপিন বলিলেন 一 “ব্যস্ত হচ্ছেন কেন সার, এই ভো ফর্দ রয়েছে, দেখুন না — জমি-কেনা, শেয়ারের দালালি, preliminary expense, ইট- তৈরি, establishment, বিজ্ঞাপন, আপিস-খরচ

তিনকড়ি। চোপ রও ছোকরা। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা ৷

এমন সময় শ্যামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন । বলিলেন – ‘ব্যাপার কি ?

তিনকড়ি। ব্যাপার আমার মাথা । আমি হিসেব চাই।

শ্যাম। বেশ তো, দেখুন না হিসেব। বরঞ্চ একদিন গোবিন্দপুরে নিজে গিয়ে কাজকর্ম তদারক ক’রে আসুন৷

তিনকড়ি। হ্যাঃ, আমি এই বাতের শরীর নিয়ে তোমার ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে মরি আর কি। সে হবে না一আমার টাকা ফেরত দাও। কোম্পানি তো যেতে বসেছে। শেয়ারহোল্ডাররা মার-মার কাট-কাট করছে।

শ্যামবাবু কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া বলিলেন ‘সকলই জগন্মাতার ইচ্ছা। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। এতদিন তো মন্দির শেষ হওয়ারই কথা। কতক-গুলো অজ্ঞাতপূর্ব কারণে খরচ বেশী হয়ে গিয়ে টাকার অনাটন হয়ে পড়ল, তাতে আমাদের আর অপরাধ কি? কিন্তু চিন্তার কোনও কারণ নেই, ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা call-এর টাকা তুললেই সমস্ত দেনা শোধ হয়ে যাবে, কাজও এগোবে।’

গণ্ডেরি বলিলেন – ‘আউর টাকা কোই দিবে না, অপকো থোড়াই বিশোআস করবে।’

শ্যাম। বিশ্বাস না করে, নাচার। আমি দায়মুক্ত, মা যেমন ক’রে পারেন নিজের কাজ চালিয়ে নিন। আমাকে বাবা বিশ্বনাথ কাশীতে টানছেন, সেখানেই আশ্রয় নেব।

তিনকড়ি৷ তবে বলতে চাও, কোম্পানি ডুবল?

গণ্ডেরি। বিশ হাঁথ পানি।

শ্যাম। আচ্ছা তিনকড়িবাবু, আমাদের ওপর যখন লোকের এতই অবিশ্বাস, বেশ তো, আমরা না-হয় ম্যানেজিং এজেন্সি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনার নাম আছে সম্ভ্রম আছে, লোকেও শ্রদ্ধা করে, আপনিই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে কোম্পানি চালান না?

অটল। এইবার পাকা কথা বলেছেন ।

তিনকড়ি। হ্যাঁ, আমি বদনামের বোঝা ঘাড়ে নিই, আর ঘরের খেয়ে বুনো মোষ তাড়াই ৷

শ্যাম। বেগার খাটবেন কেন ? আমিই এই মিটিংএ প্রস্তাব করছি যে রায়সাহেব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি ব্যানার্জি মহাশয়কে মাসিক ১০০০, পারিশ্রমিক দিয়ে কোম্পানি চালাবার ভার অর্পণ করা হোক। এমন উপযুক্ত কর্মদক্ষ লোক আর কোথা? আর, আমরা যদি ভুলচুক করেই থাকি, তার দায়ী তো আর আপনি হবেন না।

তিনকড়ি । তা তা আমি চট্‌ ক’রে কথা দিতে পারিনে। ভেবে-চিন্তে দেব। অটল। আর দ্বিধা করবেন না রায়সাহেব। আপনিই এখন ভরসা।

শ্যাম। যদি অভয় দেন তো আর একটি নিবেদন করি। আমি বেশ বুঝেছি, অর্থ হচ্ছে সাধনের অন্তরায় । আমার সমস্ত সম্পত্তিই বিলিয়ে দিয়েছি, কেবল এই কোম্পানির ষোল-শ খানেক শেয়ার আমার হাতে আছে । তাও সৎপাত্রে অর্পণ করতে চাই। আপনিই সেটা নিয়ে নিন। প্রিমিয়ম চাই না আপনি কেনা-দাম ৩২০০, মাত্র দিন ।

তিনকড়ি। হ্যাঃ, ভাল ক’রে আমার ঘাড় ভাঙবার মতলব। শ্যাম। ছি ছি। আপনার ভালই হবে । না হয় কিছু কম দিন, চব্বিশ-শ – দু-হাজার – হাজার –

তিনকড়ি৷ এক কড়াও নয়।

শ্যাম। দেখুন, ব্ৰাহ্মণ হ’তে ব্রাহ্মণের দান - প্রতিগ্রহ নিষেধ, নইলে আপনার মত লোককে আমার অমনিই দেবার কথা । আপনি যৎকিঞ্চিৎ মূল্য ধরে দিন। ধরুন – পাঁচ-শ টাকা। ট্রান্সফার ফর্ম আমার প্রস্তুতই আছে নিয়ে এস তো বিপিন।

তিনকড়ি। আমি এ-এ-আশি টাকা দিতে পারি।

শ্যাম। তথাস্তু। বড়ই লোকসান হ’ল, কিন্তু সকলই মায়ের ইচ্ছা।

গণ্ডেরি। বাহ্বা তিনকৌড়িবাবু, বহুত কিফায়ত হুয়া!

তিনকড়িবাবু পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া সদ্যঃপ্রাপ্ত পেনশনের টাকা হইতে আটখানা আনকোরা দশ টাকার নোট সন্তর্পণে গনিয়া দিলেন। শ্যামবার, পকেটস্থ করিয়া বলিলেন ‘তবে এখন আমি আসি৷ বাড়িতে সত্যনারায়ণের পূজা আছে। আপনিই কোম্পানির ভার নিলেন এই কথা স্থির। শুভমস্তু 一 মা-দশভুজা আপনার মঙ্গল করুন।’

শ্যামবাবু প্রস্থান করিলে তিনকড়িবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন – ‘লোকটা দোষে গুণে মানুষ । এদিকে যদিও হাম্‌বগ, কিন্তু মেজাজটা দিলদরিয়া। কোম্পানির ঝক্কিটা তো এখন আমার ঘাড়ে পড়ল । ক-মাস বাতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলুম, কিছুই দেখতে পারিনি, নইলে কি কোম্পানির অবস্থা এমন হয়? যা হোক, উঠে-প’ড়ে লাগতে হ’ল 一 আমি লেফাফা-দুরস্ত কাজ চাই, আমার কাছে কারও চালাকি চলবে না।’

গণ্ডেরি। অপনের কুছু তকলিফ করতে হোবে না। কম্পানি তো ডুব গিয়া। অপকোভি ছুটি । তিনকড়ি। তা হ’লে কি বলতে চাও আমার মাসহারাটা一 গণ্ডেরি। হাঃ হাঃ, তুভি রুপয়া লেওগে? কাঁহাসে মিলবে বাতলাও । তিনকৌড়িবাবু, শ্যামবাবুকা কাররবাই নহি সমঝা? নব্বে হাজার রুপয়া কম্পনিকা দেনা। দো রোজ বাদ লিকুইডেশন। লিকুইডেটের সিকিণ্ড কল আদায় করবে তব, দেনা শুধবে ৷

তিনকড়ি। অ্যাঁ, বল কি? আমি আর এক পয়সাও দিচ্ছি না।

গণ্ডেরি ৷ আলবত দিবেন। গবরমিন্ট কান পকড়কে আদায় করবে। আইন এইসি হ্যায়।

তিনকড়ি। আরও টাকা যাবে ৷ সে কত ?

অটল। আপনার একলার নয়। প্রত্যেক অংশী-দারকেই শেয়ার-পিছু ফের ছ-টাকা দিতে হবে । আপনার পূর্বের ২০০ শেয়ার ছিল, আর শ্যাম-দার ১৬০০ আজ নিয়েছেন। এই ১৮০০ শেয়ারের ওপর আপনাকে ছত্রিশ শ টাকা দিতে হবে। দেনা শোধ, লিকুইডেশনের খরচা一 সমস্ত চুকে গেলে শেষে সামান্য কিছু ফেরত পেতে পারেন।

তিনকড়ি। তোমাদের কত গেল?

গণ্ডেরি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ সঞ্চালন করিয়া বলিলেন – ‘কুছ ভি নহি, কুছ ভি নহি! আরে হামাদের ঝড়তি-পড়তি শেয়ার তো সব শ্যামবাবু লিয়েছিল — আজ অপনেকে বিকিরি কিয়েছে।’

তিনকড়ি। চোর চোর চোর! আমি এখনি বিলেতে কোল্ডহাম সাহেবকে চিঠি লিখছি 一

অটল। তবে আমরা এখন উঠি। আমাদের তো আর শেয়ার নেই, কাজেই আমরা এখন ডিরেক্টর নই। আপনি কাজ করুন। চল গণ্ডেরি। তিনকড়ি। আঁ 一

গণ্ডেরি। রাম রাম!

চিকিৎসা-সংকট - ১