
মহাবিদ্যা - ২
হোমরাও। লোকটির চেহারা কি বীভৎস! চেনেন নাকি মিস্টার গ্র্যাব?
গ্র্যাব। চেনা চেনা বোধ হচ্ছে।
জগদ্গুরু। হে ছাত্রগণ, তোমাদের আশীর্বাদ করছি জগজ্জয়ী হও। আমি যে-বিদ্যা শেখাতে এসেছি তার জন্য অনেক সাধনা দরকার তোমরা একদিনে সব বুঝতে পারবে না। আজ আমি কেবল আজ আমি কেবল ভূমিকা মাত্র বলব। হে বালকগণ, তোমরা মন দিয়ে শোন যেখানে খটকা ঠেকবে, আমাকে নির্ভয়ে জিজ্ঞাসা করবে।
প্রফেসার গুঁই। আমি স্ট্রংলি আপত্তি করছি – জগদ্গুরু কেন আমাদের ‘বালকগণ – তোমরা’ বলবেন? আমরা কি স্কুলের ছোকরা? এটা একটা রেস্পেক্টেল গ্যাদারিং। এই মহারাজা হোমরাও সিং, নবাব চোমরাও আলি রয়েছেন। পদমর্যাদা যদি না ধরেন, বয়সের একটা সম্মান তো আছে ৷ আমাদের মধ্যে অনেকের বয়স ঘাট পেরিয়েছে। হাউলার। আপনাদের বাংলা ভাষার দোষ । জগদ্গুরু বিদেশী লোক, ‘আপনি’ ‘তুমি’ গুলিয়ে ফেলেছেন । আর ‘বালক’ কথাটা কিছু নয়, ইংরেজীর ওল্ড বয়।
খুদীন্দ্র। বাংলা ভাল না জানেন তো ইংরাজীতে বলুন না।
গুঁই। যাই হ’ক আমি আপত্তি করছি।
মিস্টার গুহা। আমি আপত্তির সমর্থন করছি।
জগদ্গুরু (সহাস্যে )। বৎস, উতলা হয়ো না । আমি বাংলা ভালই জানি। বাংলা, ইংরেজী, ফরাসী, জাপানী, সবই আমার মাতৃভাষা। আমি প্রবীণ লোক, দশ-বিশ হাজার বৎসর ধ’রে এই মহাবিদ্যা শেখাচ্ছি। তোমরা আমার স্নেহের পাত্র, ‘তুমি’ বলবার অধিকার আমার আছে।
লুটবেহারী। নিশ্চয় আছে। আপনি আমাদের ‘তুমি, তুই’ যা খুশি বলুন। আমি ও-সব গ্রাহ্য করি না। মোদ্দা, শেষকালে ফাঁকি দেবেন না।
জগদ্গুরু। বাপু, আমি কোনও জিনিস দিই না, শুধু শেখাই মাত্র ৷ যা হ’ক, তোমাদের দেখে আমি বড়ই প্রীত হয়েছি। এমন সব সোনার চাঁদ ছেলে – কেবল শিক্ষার অভাবে উন্নতি করতে পারছ না!
মিস্টার গুপ্টা। ভণিতা ছেড়ে কাজের কথা বলুন।
জগদ্গুরু। হে ছাত্রগণ, মহাবিদ্যা না জানলে মানুষ তাকে চিরকাল কাঠ সুসভ্য ধনী মানী হ’তে পারে না, কাটতে আর জল তুলতে হয়। কিন্তু এটা মনে রেখো যে, সাধারণ বিদ্যা আর মহাবিদ্যা এক জিনিস নয়। তোমরা পদ্যপাঠে পড়েছ— এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে৷ এই কথা সাধারণ বিদ্যা সম্বন্ধে খাটে, কিন্তু মহাবিদ্যার বেলা নয়। মহাবিদ্যা কেবল নিতান্ত অন্তরঙ্গ জনকে অতি সন্তর্পণে শেখাতে হয়। বেশী প্রচার হ’লে সমূহ ক্ষতি । বিদ্বানে বিদ্বানে সংঘর্ষ হ’লে একটু বাক্যব্যয় হয় মাত্র, কিন্তু মহাবিদ্বানদের ভিতর ঠোকাঠুকি বাধলে সব চুরমার। তার সাক্ষী এই ইওরোপের যুদ্ধ। অতএব মহাবিদ্বানদের একজোট হয়েই কাজ করতে হবে।
হাউলার । আমি এই লেকচারে আপত্তি করছি। এদেশের লোকে এখনও মহাবিদ্যালাভের উপযুক্ত হয় নি। আর আমাদের মহাবিদ্যানরা দেশী মহাবিদ্যাদের সঙ্গে বনিয়ে চলতে পারবে না। মিথ্যা একটা অশান্তির সৃষ্টি হবে।
গ্র্যাব। চুপ কর হাউলার। মহাবিদ্যা শেখা কি এ দেশের লোকের কর্ম? . লেকচার শুনে হুজুকে প’ড়ে যদি মহাবিদ্যা নিয়ে লোকে একটু ছেলেখেলা আরম্ভ করে, মন্দ কি? একটু অন্যদিকে ডিস্ট্র্যাকশন হওয়া দেশের পক্ষে এখন দরকার হয়েছে।
হাউলার। সাধারণ বিদ্যা যখন এদেশে প্রথম চালানো হয় তখনও আমরা ব্যাপারটাকে ছেলেখেলা মনে করেছিলুম। এখন দেখছ তো ঠেলা? জোর ক’রে টেক্সট বুক থেকে এটা-সেটা বাদ দিয়ে কি আর সামলানো যাচ্ছে?
খুদীন্দ্র। মিস্টার হাউলার ঠিক বলছেন। আমারও ভাল ঠেকছে না ।
চোমরাও আলি। ভাল-মন্দ গভর্নমেণ্ট বিচার করবেন। তবে মহাবিদ্যা যদি শেখাতেই হয়, মুসলমানদের জন্য একটা আলাদা ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।
জগদ্গুরু। সাধারণ বিদ্যা মোটামুটি জানা না থাকলে মহাবিদ্যায় ভাল রকম ব্যুৎপত্তি লাভ হয় না৷ পাশ্চাত্ত্য দেশে দুই বিদ্যার মণিকাঞ্চন যোগ হয়েছে ৷ এ-দেশেও যে মহাবিদ্যান্ নেই, তা নয়—
গাঁট্টালাল। হুঁ হুঁ গুরুজী আমাকে মালুম করছেন।
রূপচাঁদ৷ দূর, তোকে কে চেনে? আমার দিকে চাইছেন৷
জগদ্গুরু। তবে মূর্খ লোকে মহাবিদ্যার প্রয়োগটা আত্মসম্ভ্রম বাঁচিয়ে করতে পারে না। পাশ্চাত্য দেশ এ বিষয়ে অত্যন্ত উন্নত। জরির খাপের ভিতর যেমন তলোয়ার ঢাকা থাকে, মহাবিদ্যাকেও তেমনি সাধারণ বিদ্যা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়। মহাবিদ্যার মূল সূত্রই ইচ্ছে – যদি না পড়ে ধরা।
প্রফেসার গুঁই। আপনি কী সব খারাপ কথা বলছেন!
অনেকে। শেম, শেম ৷ জগদ্গুরু। বৎস, লজ্জিত হয়ো না। তোমাদেরই এক পণ্ডিত বলেন – একাং লজ্জাং পরিত্যজ্য ত্রিভুবন-বিজয়ী ভব। যদি মহাবিদ্যা শিখতে চাও তবে সত্যের উলঙ্গ মূর্তি দেখে ডরালে চলবে না। যা বলছিলুম শোন। এই মহাবিদ্যা যখন মানুষ প্রথমে শেখে তখন সে আনাড়ী শিকারীর মত বিদ্যার অপপ্রয়োগ করে। যেখানে ফাঁদ পেতে কার্যসিদ্ধি হ’তে পারে সেখানে সে কুস্তি ল’ড়ে বাঘ মারতে যায় । দু-চারটে বাঘ হয়তো মরে; কিন্তু শিকারীও শেষে ঘায়েল হয়। বিদ্যাগুপ্তির অভাবেই এই বিপদ হয়। মানুষ যখন আর একটু চালাক হয়, তখন সে ফাঁদ পাততে আরম্ভ করে, নিজে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু গোটাকতক বাঘ ফাঁদে পড়লেই আর সব বাঘ ফাঁদ চিনে ফেলে, আর সেদিকে আসে না, আড়াল থেকে টিটকারি দেয়, শিকারীরও ব্যাবসা বন্ধ হয়। ফাঁদটা এমন হওয়া চাই যেন কেউ ধ’রে না ফেলে। মহাবিদ্যাও সেই রকম গোপন রাখা দরকার। তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো নিজের অজ্ঞাতসারে কেবল সংস্কারবশে মহাবিদ্যার প্রয়োগ কর। এতে কখনও উন্নতি হবে না। পরের কাছে প্রকাশ করা নিষেধ; কিন্তু নিজের কাছে লুকোলে মহাবিদ্যায় মরচে পড়বে। সজ্ঞানে ফলাফল বুঝে মহাবিদ্যা চালাতে হয় ৷
গুঁই। বড়ই গোলমেলে কথা ।
লুটবেহারী। কিছু না, কিছু না। জগদগুরু নূতন কথা আর কি বলছেন । প্র্যাকটিস আমার সবই জানা আছে, তবে থিওরিটা শেখবার তেমন সময় পাইনি।
গুহা। এতদিন ছিলে কোথা হে?
লুটবেহারী। শ্বশুরবাড়ি। সেদিন খালাস পেয়েছি।
গুহা। নাঃ, তোমার দ্বারা কিছু হবে না । এই তো ধরা দিয়ে ফেললে।
লুটবেহারী। আপনাকে বলতে আর দোষ কি। দু-জনেই মহাবিদ্বান্, মাসতুতো ভাই।
হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।
গুহা। আচ্ছা গুরুদেব, মহাবিদ্যা শিখলে কি আমাদের দেশের সকলেরই উন্নতি হবে?
জগদ্গুরু। দেখ বাপু, পৃথিবীর ধনসম্পদ্ যা দেখছ, তার একটা সীমা আছে, বেশী বাড়ানো যায় না। সকলেই যদি সমান ভাগে পায়, তবে কারও পেট ভরে না। যে জিনিস সকলেই অবাধে ভোগ করতে পারে, সেটা আর সম্পত্তি বলে গণ্য হয় না। কাজেই জগতের ব্যবস্থা এই হয়েছে যে জনকতক ভোগদখল করবে, বাকি সবাই যুগিয়ে দেবে। চাই গুটিকতক মহাবিদ্বান্ আর একগাদা মহামূর্খ৷
খুদীন্দ্র। শুনছেন মহারাজা? এই কথাই তে আমরা বরাবর ব’লে আসছি। আরিস্টোক্রাসি না হ’লে সমাজ টিকবে কিসে? লোক আবার আমাদের বলে মূর্খ — অযোগ্য। হুঃ!
জগদ্গুরু। ভুল বুঝলে বৎস। তোমার পূর্বপুরুষরাই মহাবিদ্বান্ ছিলেন, তুমি নও। তুমি কেবল অতীতে অর্জিত বিদ্যার রোমন্থন করছ। তোমার আশে-পাশে মহাবিদ্যানুরা ওত পেতে বসে আছেন। যদি তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না শেখ তবে শীঘ্রই গাদায় গিয়ে পড়বে।
প্রফেসর গুঁই। পরিষ্কার করেই বলুন না মহাবিদ্যাটা কি।
তৃতীয় শ্রেণী হইতে। ব’লে ফেলুন সার, ব’লে ফেলুন। ঘণ্টা বাজতে বেশী দেরী নেই।
জগদগুরু। তবে বলছি শোন। মহাবিদ্যায় মানুষের জন্মগত অধিকার; কিন্তু একে ঘষে মেজে পালিশ ক’রে সভ্যসমাজের উপযুক্ত ক’রে নিতে হয়। ক্রমোন্নতির নিয়মে মহাবিদ্যা এক স্তর হ’তে উচ্চতর স্তরে পৌঁছেছে। জানিয়ে শুনিয়ে সোজাসুজি কেড়ে নেওয়ার নাম ডাকাতি —
ছাত্রগণ। সেটা মহাপাপ – চাই না, চাই না।
জগদগুরু। দেশের জন্য যে ডাকাতি, তার নাম বীরত্ব– ছাত্রগণ। তা আমাদের দিয়ে হবে না, হবে না।
হাউলার। Bally rot।
জগদ্গুরু। নিজে লুকিয়ে থেকে কেড়ে নেওয়ার নাম চুরি–
ছাত্রগণ। ছ্যা ছ্যা, আমরা তাতে নেই, তাতে নেই৷
লুটবেহারী। কিহে গাঁট্টালাল, চুপ ক’রে কেন? সায় দাও না।
জগদ্গুরু। ভালমানুষ সেজে কেড়ে নিয়ে শেষে ধরা পড়ার নাম জুয়াচুরি-
ছাত্রগণ। রাম কহ, তোবা, থুঃ।
গুহা। কি লুটবেহারী, চোখ বুজে কেন?
জগদ্গুরু। আর যাতে ঢাক পিটিয়ে কেড়ে নেওয়া যায়, অথচ, শেষ পর্যন্ত নিজের মানসম্ভ্রম বজায় থাকে, লোকে জয়জয়কার করে – সেটা মহাবিদ্যা।
ছাত্রগণ। জগদ্গুরু কি জয়! আমরা তাই চাই, তাই চাই ৷
গুঁই। কিন্তু ঐ কেড়ে নেওয়া কথাটা একটু আপত্তিজনক৷
লুটবেহারী। আপনার মনে। আপনার মনে পাপ আছে, তাই খটকা বাধছে। কেড়ে নেওয়া পছন্দ না হয়, বলুন ভোগা দেওয়া।
গুঁই৷ কে হে বেহায়া তুমি? তোমার কনশেন্স নেই?
জগদ্গুরু। বৎস, কেড়ে নেওয়াটা রূপক মাত্র। সাদা কথায় এর মানে হচ্ছে – সংসারের মঙ্গলের জন্য লোককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু আদায় করা।
লুটবেহারী। আমার তো সবে একটি সংসার। কিছু আদায় করতে পারলেই ছছল-বছল। নবাব-সাহেবের বরঞ্চ–
হোমরাও। অর্ডার, অর্ডার।
গুঁই। দেখুন জগদ্গুরু, আমার দ্বারা বিবেক-বিরুদ্ধ কাজ হবে না। কিন্তু ঐ যে আপনি বললেন – সংসারের মঙ্গলের জন্য, সেটা খুব মনে লেগেছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি—