
শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড - ১
মাঘ মাস ১৩২৬ সাল। এই মাত্র আরমানী গির্জার ঘড়িতে বেলা এগারটা বাজিয়াছে। শ্যামবাবু চামড়ার ব্যাগ হাতে ঝুলাইয়া জুডাস লেনের একটি তেতলা বাড়িতে প্রবেশ করিলেন। বাড়িটি বহু পুরাতন, ক্রমাগত চুন ও রঙের প্রলেপে লােলচর্ম কলপিত-কেশ বৃদ্ধের দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। নীচের তলায় অন্ধকারময় মালের গুদাম। উপরতলায় সম্মুখভাগে অনেকগুলি ব্যবসায়ীর আপিস, পশ্চাতে বিভিন্ন জাতীয় কয়েকটি পরিবার পৃথক পৃথক অংশে বাস করেন। প্রবেশদ্বারের সম্মুখেই তেতলা পর্যন্ত বিস্তৃত কাঠের সিড়ি। সিড়ির পাশের দেওয়াল আগাগােড়া তাম্বুলরাগচর্চিত—যদিও নিষেধের নােটিস লম্বিত আছে। কতিপয় নেংটে ইদুর ও আরসােলা পরস্পর অহিংসভাবে স্বচ্ছন্দে ইতস্তত বিচরণ করিতেছে। ইহার আশ্রম মৃগের ন্যায় নিঃশঙ্ক, সিড়ির যাত্রিগণকে গ্রাহ্য করে না। অন্তরালবর্তী সিন্ধী-পরিবারের রান্নাঘর হইতে নির্গত হিঙের তীব্র গন্ধের সহিত নরদমার গন্ধ মিলিত হইয়া সমস্ত স্থান আমােদিত করিয়াছে। আপিস-সমূহের মালিকগণ তুচ্ছ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকিয়া কেনা-বেচা তেজি-মন্দি আদায়-উসুল ইত্যাদি মহৎ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হইয়া দিন যাপন করিতেছেন।
শ্যামবাবু তেতলায় উঠিয়া একটি ঘরের তালা খুলিলেন। ঘরের দরজার পাশে কাষ্ঠফলকে লেখা আছে -ব্রহ্মচারী অ্যাণ্ড ব্রাদার-ইন-ল, জেনার্ল মার্চেন্টস। এই কারবারের স্বত্বাধিকারী স্বয়ং শ্যামবাবু (শ্যামলাল গাঙ্গুলী) এবং তাহার শ্যালক বিপিন চৌধুরী, বি. এস্ -সি। ঘরে কয়েকটি পুরাতন টেবিল, চেয়ার, আলমারি প্রভৃতি আপিস-সরঞ্জাম। টেবিলের উপর নানাপ্রকার খাতা, বিতরণের জন্য ছাপানাে বিজ্ঞাপনের স্তুপ, একটি পুরাতন থ্যাকার্স ডিরেক্টরি, একখণ্ড ইণ্ডিয়ান কম্পানিজ অ্যাক্ট, কয়েকটি বিভিন্ন কম্পানির নিয়মাবলী বা articles, এবং অন্যবিধ কাগজপত্র। দেওয়ালে সংলগ্ন তাকের উপর কতকগুলি ধূলিধূসর কাগজমােড়া শিশি এবং শূন্যগর্ভ মাদুলি। এককালে শ্যামবাবু পেটেন্ট ও স্বপ্নাদ্য ঔষধের কারবার করিতেন, এগুলি তাহারই নিদর্শন।
শ্যামবাবুর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, গাঢ় শ্যাম বর্ণ, কাঁচা-পাকা দাড়ি, আকণ্ঠলম্বিত কেশ, স্থুল লােমশ বপু। অল্পবয়স হইতেই তাহার স্বাধীন ব্যবসায়ে ঝোঁক, কিন্তু এ পর্যন্ত নানাপ্রকার কারবার করিয়াও বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। ই. বি. রেলওয়ে অডিট আপিসের চাকরিই তাহার জীবিকানির্বাহের প্রধান উপায়। দেশে কিছু দেবােত্তর সম্পত্তি এবং একটি জীর্ণ কালীমন্দির আছে, কিন্তু তাহার আয় সামান্য। চাকরির অবকাশে ব্যবসায়ের চেষ্টা করেন এ বিষয়ে শ্যালক বিপিনই তাহার প্রধান সহায়। সন্তানাদি নাই, কলিকাতার বাসায় পত্নী এবং শ্যালক সহ বাস করেন। ব্যবসায়ের কিছু উন্নতি হইলেই চাকরি ছাড়িয়া দিবেন, এইরূপ সংকল্প আছে। সম্প্রতি ছয় মাসের ছুটি লইয়া নূতন উদ্যমে ব্রহ্মচারী আণ্ড ব্রাদার ইন-ল নামে আপিস প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।
শ্যামবাবু ধর্মভীরু লােক, পঞ্জিকা দেখিয়া জীবন যাত্রা নির্বাহ করেন এবং অবসর-মত তান্ত্রিক সাধনা করিয়া থাকেন। বৃথা - অর্থাৎ ক্ষুধা না থাকিলে - মাংসভােজন, এবং অকারণে কারণ পান করেন না। কোন্ সন্ন্যাসী সােনা করিতে পারে, কাহার নিকট দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ বা একমুখী রুদ্রাক্ষ আছে, কে পারদ ভস্ম করিতে জানে, এই সকল সন্ধান প্রায়ই লইয়া থাকেন। কয়েক মাস হইতে বাটীতে গৈরিক বাস পরিধান করিতেছেন এবং কতকগুলি অনুরক্ত শিষ্যও সংগ্রহ করিয়াছেন। শ্যামবাবু আজকাল মধ্যে মধ্যে নিজেকে ‘শ্রীমৎ শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী’ আখ্যা দিয়া থাকেন, এবং অচিরে এই নামে সর্বত্র পরিচিত হইবেন এরূপ আশা করেন।
শ্যামবাবু তাঁহার আপিস-ঘরে প্রবেশ করিয়া একটি সার্ধ-ত্রিপাদ ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া ডাকিলেন - “বাঞ্ছা, ওরে বাঞ্ছা। বাঞ্ছা শ্যামবাবুর আপিসের বেয়ারা - এতক্ষণ পাশের গলিতে টুলে বসিয়া ঢুলিতেছিল - প্রভুর ডাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিল। শ্যামবাবু বলিলেন - ‘গঙ্গাজলের বােতলটা আন্, আর খাতাপত্রগুলাে একটু ঝেড়ে-মুছে রাখ, যা ধুলাে হয়েছে। বাঞ্ছা একটা তামার কুপি আনিয়া দিল। শ্যামবাবু তাহা হইতে কিঞ্চিৎ গঙ্গোদক লইয়া মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক গৃহমধ্যে ছিটাইয়া দিলেন। তার পর টেবিলের দেরাজ হইতে একটি সিন্দুর-চর্চিত রবার স্ট্যাম্পের সাহায্যে ১০৮ বার দুর্গানাম লিখিলেন। স্ট্যাম্পে ১২ লাইন ‘শ্রীশ্রীদুর্গা’ খােদিত আছে, সুতরাং ৯ বার ছাপিলেই কার্যোদ্ধার হয়। এই শ্রমহারক যন্ত্রটির আবিষ্কর্তা শ্ৰীমান বিপিন। তিনি ইহার নাম দিয়াছেন – “দি অটোম্যাটিক শ্রীদুর্গাগ্রাফ’ এবং পেটেন্ট লইবার চেষ্টায় আছেন।
উক্ত প্রকার নিত্যক্রিয়া সমাধা করিয়া শ্যামবাবু প্রসন্নচিত্তে ব্যাগ হইতে ছাপাখানার একটি ভিজা প্রুফ বাহির করিয়া লইয়া সংশােধন করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে জুতার মশমশ শব্দ করিতে করিতে অটলবাবু ঘরে আসিয়া বলিলেন – এই যে স্যাম-দা, অনেকক্ষণ এসেছেন বুঝি? বড় দেরি হয়ে গেল, কিছু মনে করবেন না – হাইকোর্টে একটা মােশন ছিল। ব্রাদার-ইন-ল কোথায়?
শ্যামবাবু। বিপিন গেছে বাগবাজারে তিনকড়ি বাড়জ্যের কাছে। আজ পাকা কথা নিয়ে আসবে। এই এল বলে।
অটলবাবু চাপকান-চোগা-ধারী সদ্যোজাত অ্যাটর্নি, পিতার আপিসে সম্প্রতি জুনিয়ার পার্টনার-রূপে যােগ দিয়াছেন। গৌরবর্ণ, সুপুরুষ, বিপিনের বাল্যবন্ধু। বয়সে নবীন হইলেও চাতুর্যে পরিপক্ক। জিজ্ঞাসা করিলেন - ‘বুড়াে রাজী হ’ল ? আচ্ছা, ওকে ধরলেন কি করে?’
শ্যাম। আরে তিনকড়িবাৰু হলেন গে শরতের খুড়শ্বশুর। বিপিনের মাস্তুতাে ভাই শরৎ। ঐ শরতের সঙ্গে গিয়ে তিনকড়িবাবুকে ধরি। সহজে কি রাজী হয়? বুড়াে যেমন কনজুস তেমনি সন্দিগ্ধ। বলে – আমি হলুম রায়সাহেব, রিটায়ার্ড ডেপুটি, গভরমেন্টের কাছে কত মান। কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে কি শেষে পেনশন খােয়াব ? তখন নজির দিয়ে বােঝালুম - কত রিটায়ার্ড বড় বড় অফিসার তো ডিরেক্টরি করছেন, আপনার কিসের ভয়? শেষে যখন শুনলে যে, প্রতি মিটিংএ ৩২ টাকা ফী পাবে, তখন একটু ভিজল।
অটল। কত টাকার শেয়ার নেবে?
শ্যাম। তাতে বড় হুশিয়ার। বলে - তােমার ব্রহ্মচারী কোম্পানি যে লুঠ করবে না, তার জামিন কে? তােমরা শালা-ভগ্নীপতি মিলে ম্যানেজিং এজেন্ট হয়ে কোম্পানিকে ফেল করলে আমার টাকা কোথায় থাকবে? বললুম – মশায়, আপনার মত বিচক্ষণ সাবধানী ডিরেক্টর থাকতে কার সাধ্য লুঠ করে। খরচপত্র তত আপনার চোখের সামনেই হবে। ফেল হতে দেবেন কেন? মন্দটা যেমন ভাবছেন, ভালর দিকটাও দেখুন। কি রকম লাভের ব্যবসা! খুব কম করেও যদি ৫০ পারসেন্ট ডিভিডেণ্ড পান তবে দু-বছরের মধ্যেই তো আপনার ঘরের টাকা ঘরে ফিরে এল। শেষে অনেক তর্কাতর্কির পর বললে – আচ্ছা, আমি শেয়ার নেব, কিন্তু বেশী নয়, ডিরেক্টর হতে হলে যে টাকা দেওয়া দরকার তার বেশী নেব না। আজ মত স্থির করে জানাবেন, তাই বিপিনকে পাঠিয়েছি।
অটল। অমন খুঁতখুঁতে লােক নিয়ে ভাল করলেন না শ্যাম-দা। আচ্ছা, মহারাজাকে ধরলেন না কেন?
শ্যাম। মহারাজাকে ধরতে বড়-শিকারী চাই, তােমার আমার কর্ম নয়। তা ছাড়া পাঁচ ভূতে তাঁকে শুষে নিয়েছে, কিছু আর পদার্থ রাখে নি।
অটল। খােট্টাটি ঠিক আছে তাে? আসবে কখন?
শ্যাম। সে ঠিক আছে, এই রকম দাঁও মারতেই তো সে চায়। এতক্ষণ তার আসা উচিত ছিল। প্রসপেক্টসটা তােমাদের শুনিয়ে আজই ছাপাতে দিতে চাই। তিনকড়িবাবুকে আসতে বলেছিলুম, বাতে ভুগছেন, আসতে পারবেন না জানিয়েছেন। ‘রাম রাম বাবুসাহেব!’
আগন্তক মধ্যবয়স্ক, শ্যামবর্ণ, পরিধানে সাদা ধুতি, লম্বা কাল বনাতের কোট, পায়ে বার্নিশ-করা জুতা, মাথায় হলদে রঙের ভাজ-করা মলমলের পাগড়ি, হাতে অনেকগুলি আংটি, কানে পান্নার মাকড়ি, কপালে ফোটা।
শ্যামবাবু বলিলেন – ‘আসুন, আসুন – ওরে বাঞ্ছা, আর একটা চেয়ার দে। এই ইনি হচ্ছেন অটলবাবু, আমাদের সলিসিটর দত্ত কোম্পানির পার্টনার। আর ইনি হলেন আমার বিশেষ বন্ধু - বাবু গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া।’
গণ্ডেরি। নােমােস্কার, আপনের নাম শুনা আছে, জান-পহচান হয়ে বড় খুশ হ’ল।
অটল। নমস্কার, এই আপনার জন্যই আমরা বসে আছি। আপনার মত লােক যখন আমাদের সহায়, তখন কোম্পানির আর ভাবনা কি?
গণ্ডেরি। হেঁ হেঁ, সােকোলি ভগবানের হিঁছা। হামি একেলা কি করতে পারি? কুছু না।
শ্যাম। ঠিক, ঠিক। যা করেন মা তারা দীনতারিণী। দেখ অটল, গণ্ডেরিবাবু যে কেবল পাকা ব্যবসাদার, তা মনে করাে না। ইংরিজী ভাল না জানলেও ইনি বেশ শিক্ষিত লােক, আর শাস্ত্রেও বেশ দখল আছে।
অটল। বাঃ, আপনার মত লােকের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বড় সুখী হলুম। আচ্ছা মশায়, আপনি এমন সুন্দর বাংলা বলতে শিখলেন কি করে?
গণ্ডেরি। বহুত বাঙ্গালীর সঙে হামি মিলা মিশা করি। বাংলা কিতাব ভি অহেক পঢ়েছি। বঙ্কিমচন্দ, রবীন্দ্রনাথ, আউর ভি সব।
এমন সময় বিপিনবাবু আসিয়া পেীছিলেন। ইনি একটু সাহেবী মেজাজের লোক, এককালে বিলাত যাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পরিধানে সাদা প্যান্ট, কাল কোট, লাল নেকটাই, হাতে সবুজ ফেল্ট হাট। উজ্জল শ্যামবর্ণ, ক্ষীণকায়, গোঁফের দুই প্রান্ত কামানো। শ্যামবাবু উদ্গ্রীব হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন – ‘কি হল?’
বিপিন। ডিরেক্টর হবেন বলেছেন, কিন্তু মাত্র দু-হাজার টাকার শেয়ার নেবেন। তােমাকে অটলকে আমাকে পরশু সকালে ভাত খাবার নিমন্ত্রণ করেছেন। এই নাও চিঠি।
অটল। তিনকড়িবাবু হঠাৎ এত সদয় যে?
শ্যাম। বুঝলুম না। বােধ হয় ফেলো ডিরেক্টরদের একবার বাজিয়ে যাচাই করে নিতে চান।
অটল। যাক, এবার কাজ আরম্ভ করুন। আমি মেমােরান্ডম আর আর্টিকেসের মুসাবিদা এনেছি। শ্যাম-দা, প্রসপেক্টটা কি রকম লিখলেন পড়ুন।
শ্যাম। হাঁ, সকলে মন দিয়ে শােন। কিছু বদলাতে হয় তত এই বেলা। দুর্গা - দুর্গা —
জয় সিদ্ধিদাতা গণেশ ১৯১৩ সালের ৭ আইন অনুসারে রেজিস্ট্রীত শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড মুলধন—-দশ লক্ষ টাকা, ১০ হিসাবে ১০০,০০০ অংশে বিভক্ত। আবেদনের অঙ্গে অংশ-পিছু ২ প্রদেয়। বাকী টাকা চার কিস্তিতে তিন মাসের নােটিসে এয়ােজন-মত দিতে হইবে।
অনুষ্ঠানপত্র ধর্মই হিন্দুগণের প্রাণস্বরূপ। ধর্মকে বাদ দিয়া এ জাতির কোনও কর্ম সম্পন্ন হয় না। অনেকে বলেন—ধর্মের ফল পরলােকে লভ্য। ইহা আংশিক সত্য মাত্র। বস্তুত ধর্মবৃত্তির উপযুক্ত প্রয়ােগে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয়বিধ উপকার হইতে পারে। এতদর্থে সদ্য সদ্য চতুর্বর্গ লাভের উপায়স্বরূপ এই বিরাট ব্যাপারে দেশবাসীকে আহবান করা হইতেছে।
ভারতবর্ষের বিখ্যাত দেবমন্দিরগুলির কিরূপ বিপুল আয় তাহা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। রিপাের্ট হইতে জানা গিয়াছে যে বঙ্গদেশের একটি দেবমন্দিরের দৈনিক যাত্রিসংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার। যদি লােক-পিছু চার আনা মাত্র আয় ধরা যায়, তাহা হইলে বাৎসরিক আয় প্রায় সাড়ে তের লক্ষ টাকা দাড়ায়। খরচ যতই হউক, যথেষ্ট টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু সাধারণে এই লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত।
দেশের এই বৃহৎ অভাব দূরীকরণার্থে ‘শ্ৰীশ্ৰীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি স্থাপিত হইতেছে। ধর্মপ্রাণ শেয়ারহােল্ডারগণের অর্থে একটি মহান্ তীর্থক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হইবে, এবং জাগ্রত দেবী সমন্বিত সুবৃহৎ মন্দির নির্মিত হইবে। উপযুক্ত ম্যানেজিং এজেন্টের হস্তে কার্য-নির্বাহের ভার ন্যস্ত হইয়াছে। কোনও একার অপব্যয়ের সম্ভাবনা নাই। শেয়ারহােল্ডারগণ আশাতীত দক্ষিণা বা ডিভিডেন্ডও পাইবেন এবং একধারে ধর্ম অর্থ মােক্ষ লাভ করিয়া ধন্য হইবেন।
ডিরেক্টরগণ।—(১) অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বিচক্ষণ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট রায় সায়েব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। (২) বিখ্যাত ব্যবসাদার ও জোরপতি বযুক্ত গঙেরিরাম বাটপারিয়া। (৩) সলিসিটর্স দত্ত অ্যাণ্ড কোম্পানির অংশীদার শ্রীযুক্ত অটলবিহারী দত্ত, M.A. B. L. (৪) বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মিষ্টার বি. সি. চৌধুরী, B.Sc. A. S. S. (U, S. A.) (৫) কালীপদাশ্রিত সাধক ব্রহ্মচারী প্রীমৎ শ্যামানন্দ (ex-officio)।
অটলবাবু বাধা দিয়া বলিলেন 一 ‘বিপিন আবার নতুন টাইটেল পেলে কবে?
শ্যাম। ‘ আর বল কেন। পঞ্চাশ টাকা খরচ করে আমেরিকা না কামস্কাটকা কোথা থেকে তিনটে হরফ আনিয়েছে।
বিপিন। বা, আমার কোয়ালিফিকেশন না জেনেই বুঝি তারা শুধু শুধু একটা ডিগ্রী দিলে ? ডিরেক্টর হ’তে গেলে একটা পদবী থাকা ভাল নয়?
গণ্ডেরি। ঠিক বাত। ভেক বিনা ভিখ মিলে না। শ্যামবাবু, আপনিও এখনসে ধোতি-উতি ছােড় লঙোটি পিনহুন।
শ্যাম। আমি তাে আর নাগা সন্ন্যাসী নই। আমি হলুম শক্তিমন্ত্রের সাধক, পরিধেয় হ’ল রক্তাম্বর। বাড়িতে তাে গৈরিকই ধারণ করি। তবে আপিসে পরে আসি না, কারণ, ব্যাটারা সব হাঁ করে চেয়ে থাকে। আর একটু লােকের চোখ-সহা হয়ে গেলে সর্বদাই গৈরিক পরব। যাক, পড়ি শােন一 মেসাস ব্রহ্মচারী অ্যান্ড ব্রাদার-ইন-ল এই কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্সি লইতে স্বীকৃত হইয়াছেন—ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁহারা লাভের উপর শতকরা দুই টাকা মাত্র কমিশন লইবেন, এবং যতদিন না一
অটলবাবু বলিলেন – কমিশনের রেট অত কম ধরলেন কেন? দশ পার্সেন্ট অনায়াসে ফেলতে পারেন।
গণ্ডেরি। কুছু দরকার নেই। শ্যামবাবুর পরবস্তি অপনেসে হােয়ে যাবে। কমিশনের ইরাদা থােড়াই করেন। এবং যতদিন না কমিশনে মাসিক ১০০ টাকা পােষায়, ততদিন শেষােক্ত টাকা অ্যালউয়েন্স রূপে পাইবেন।
গণ্ডেরি। শুনেন অটলবাবু, শুনেন। আপনি শ্যামবাবুকে কী শিখাবেন? হুগলী জেলার অন্তঃপাতী গােবিন্দপুর গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী দেবী বহু শতাব্দী যাবৎ প্রতিষ্ঠিত আছেন। দেবীমন্দির ও তৎসংলগ্ন দেবত্র সম্পত্তির স্বত্ত্বাধিকারিণী শ্রীমতী নিস্তারিণী দেবী সম্প্রতি স্বপ্নাদেশ পাইয়াছেন যে উক্ত গােবিন্দপুর গ্রামে অধুনা সর্বপীঠের সমন্বয় হইয়াছে এবং মাতা তাহার মাহাত্মের উপযােগী সুবৃহৎ মন্দিরে বাস করিতে ইচ্ছা করেন। শ্ৰীমতী নিস্তারিণী দেবী অবলা বিধায় এবং উক্ত দৈবাদেশ স্বয়ং পালন করিতে অপারগা বিধায়, উক্ত দেবত্র সম্পত্তি মায় মন্দির বিগ্রহ জমি আওলাত আদি এই লিমিটেড কোম্পানিকে সমর্পণ করিতেছেন।
অটল। নিস্তারিণী দেবী আবার কোথা থেকে এলেন? সম্পত্তি তাে আপনার বলেই জানতুম।
শ্যাম। উনি আমার স্ত্রী। সেদিন তাঁর নামেই সব লেখাপড়া করে দিয়েছি। আমি এসব বৈষয়িক ব্যাপারে লিপ্ত থাকতে চাই না।
গণ্ডেরি। ভালা বন্দোবস্তু, কিয়েছেন। আপনেকো কোই দুসবে না। নিস্তার্নী দেবীকো কোন্ পহচানে। দাম কেত লিচ্ছেন?
অতঃপর তীর্থপ্রতিষ্ঠা, মন্দিরনির্মাণ, দেবসেবাদি কোম্পানি কর্তৃক সম্পন্ন হইবে এবং এতদর্থে কোম্পানি মাত্র ১৫,০০০ টাকা পণে সমস্ত সম্পত্তি খরিদার্থে বায়না করিয়াছেন।
গণ্ডেরি। হদ্দ、কিয়া শ্যামবাবু! জঙ্গল কি ভিতর পুরানা মন্দিল, উসমে দো-চার শও ছুছুন্দর, ছটাক ‘ভর জমীন, উপর দো-চার বাঁশ ঝাড় - বস্ ইসিকা দাম পন্দ্র হজার !!
শ্যাম। কেন, অন্যায়টা কি হল? স্বপ্নাদেশ, একান্ন পীঠ এক ঠাই, জাগ্রত দেবী - এসব বুঝি কিছু নয়? গুডউইল হিসেবে পনের হাজার টাকা খুবই কম।
গণ্ডেরি। আচ্ছা। যদি কোই শেয়ারহােল্ডার হাইকোট মে দরখাস্ত পেশ করে - স্বপন-উপন সব ঝুট, ছলায়কে রুপয়া লিয়া - তব、?
অটল। সে একটা কথা বটে, কিন্তু, এই সব আধিদৈবিক ব্যাপারে বােধ হয় অরিজিনাল সাইডের জুরিসডিকশনে পড়ে না। আইন বলে - caveat emptor, অর্থাৎ ক্রেতা সাবধান! সম্পত্তি কেনবার সময় যাচাই কর নি কেন? যা হােক একবার expert opinion নেব।