Pitara logo

ভাঙা তারা

মাতারিকি আকাশের পরী। আকাশের পরী যারা, তাদের একটি করে তারা থাকে। মাতারিকি তার তারাটিকে রােজ সকালে শিশির দিয়ে ধুয়ে মেজে এমনি চকচক করে সাজিয়ে রাখত যে, রাত্রিবেলা সবার আগে তার ওপরেই লােকের চোখ পড়ত—আর সবাই বলত—“কি সুন্দর!” তাই শুনে শুনে আর-সব আকাশ-পরীদের ভারি হিংসা হত।

তানে হচ্ছেন গাছের দেবতা। তিনি গাছে গাছে রস জোগাতেন, ডালে ডালে ফুল ফোটাতেন আর গাছের সবুজ তাজা পাতার দিকে অবাক হয়ে ভাবতেন—’এ জিনিস দেখলে পরে আর কিছুর পানে লােকে ফিরেও চাইবে না। কিন্তু লােকেরা গাছের উপর দিয়ে বার বার কেবল মাতারিকির তারা দেখত, আর কেবল তার কথাই বলত। তানের বড় রাগ হল। সে বলল, “আচ্ছা, তারার আলাে আর কত দিন? দুদিন বাদেই ঝাপসা হয়ে আসবে। কিন্তু যত দিন যায় তারা ততই উজ্জল আর ততই সুন্দর হয়, আর সবাই তার দিকে ততই বেশি করে তাকায়। একদিন অন্ধকার রাত্রে যখন সবাই ঘুমের ঘােরে স্বপ্ন দেখছে, তখন তানে চুপি-চুপি দুজন আকাশ পরীর কানে কানে বলল, “এস ভাই, আমরা সবাই মিলে মাতারিকিকে মেরে তারাটাকে। পেড়ে আনি।” পরীরা বলল, “চুপ, চুপ, মাতারিকি জেগে আছেন। পুর্ণিমার জোছনা রাতে আলােয় শুয়ে মাতারিকির চোখ যখন আপনা হতে চলে আসবে, সেই সময়ে আবার এস।”

এ-সব কথা কেউ শুনল না, শনল খালি জলের রাজার ছােট্ট একটি মেয়ে। রাজার মেয়ে রাত্রি হলেই, সেই তারাটির ছায়া নিয়ে খেলতে খেলতে জলের নীচে ঘুমিয়ে পড়ত আর মাতারিকির স্বপ্ন দেখত। দ পরার কথা শুনে তার দুচোখ ভরে জল আসল। এমন সময় দখিন হাওয়া আপন মনে গনগনিয়ে জলের ধারে এসে পড়ল। রাজার মেয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগল, “দখিন হাওয়া শুনেছ? ওরা মাতা রিকিকে মারতে চায়।” শনে দখিন হাওয়া ‘হায় হায়’ করে কেদে উঠল। রাজার মেয়ে বলল, “চুপ চুপ, এখন উপায় কি বল তাে?” এখন তারা দুজন পরামর্শ করল যে মাতারিকিকে জানাতে হবে–সে যেন পূর্ণিমার রাতে জেগে থাকে।

ভাের না হতে দখিন হাওয়া রাজার মেয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বলল, এখন যেতে হবে। সর্য তখন গানটি সেরে সিদর মেখে সােনার সাজে পবের দিকে দেখা দিচ্ছেন। রাজার মেয়ে তাঁর কাছে আবদার করল, ‘‘আমি আকাশের দেশে বেড়াতে যাব।” সূর্য তাঁর একখানি সোনালি কিরণ ছড়িয়ে দিলেন। সেই কিরণ বেয়ে বেয়ে রাজার মেয়ে উঠতে লাগলেন। সকাল বেলার কুয়াশা দিয়ে দখিন হাওয়া তাকে ঘিরে ঘিরে চারদিকেতে ঢেকে রাখল। এমনি করে রাজার মেয়ে মাতারিকির বাড়িতে গিয়ে, সব খবর বলে আসল। মাতারিকি কি করবে ? সে বলল, আমি আর কোথায় যাব? পূর্ণিমার রাতে এই খানেই পাহারা দিব–তারপর যা হয় হবে।’ রাজার মেয়ে ঝাপসা মেঘের আড়াল দিয়ে বৃষ্টি বেয়ে নেমে আসলেন।

তারপর পুর্ণিমার রাতে তানে আর দুস্ট, পরীরা ছুটে বেরল মাতারিকির তারা ধরতে। মাতারিকি দুহাত দিয়ে তারাটিকে আঁকড়ে ধ’রে, প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগল। ছুট, ছট, ছট! আকাশের আলাের নীচে, ছায়াপথের ছায়ায় ছায়ায় নিঃশব্দে ছুটোছটি আর লুকোচুরি। দখিন হাওয়া স্তন্ধ হয়ে দেখতে লাগল, রাজার মেয়ে রাত্রি জেগে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারায় তারায় আকাশ-পরী কিন্তু মাতারিকি যার কাছেই যায়, সেই তাকে দর দর করে তাড়িয়ে দেয়।

ছুটতে ছুটতে মাতারিকি হাঁপিয়ে পড়ল–আর সে ছুটতে পারে না। তখন তার মনে হল, ‘জলের দেশে রাজার মেয়ে আমায় বড় ভালােবাসে—তার কাছে লুকিয়ে থাকি। মাতারিকি ঝপ করে জলে পড়েই ডুব, ডুব, ডুব–একেবারে জলের তলায় ঠাণ্ডা কালাে ছায়ার নীচে লুকিয়ে রইল। রাজার মেয়ে অমনি তাকে শেওলায় ঢেকে আড়াল করল।

সবাই তখন খুজে সারা—কোথায় গেল, কোথায় গেল? একজন পরী বলে উঠল, “ঐ ওখানে-জলের নীচে।” তানে বলল, “বটে! মাতারিকিকে লুকিয়ে রেখেছে কে?” রাজার মেয়ের বুকের মধ্যে দুর দুর করে কেপে উঠল—কিন্তু তিনি কোন কথা বললেন না। তখন তানে বলল, “আচ্ছা দাঁড়াও, আমি এর উপায় করছি।” তখন সে জলের ধারে নেমে এসে, হাজার গাছের শিকড় মেলে শোঁ শোঁ করে জল। টানতে লাগল।

তখন মাতারিকি জল ঝেড়ে উঠে আসল। জলের নীচে আরামে শুয়ে তার পরিশ্রম দর হয়েছে, এখন তাকে ধরবে কে? আকাশময় ছুটে ছুটে কাহিল হয়ে সবাই বলছে, “আর হলাে না।” তানে তখন রেগে বলল, “হতেই হবে।” এই বলে হঠাৎ সে পথের পাশের একটা মস্ত তারা কুড়িয়ে নিয়ে, মাতারিকির হাতের দিকে ছড়ে মারল।

ঝন ঝন করে শব্দ হল, মাতারিকি হায় হায় করে কেদে উঠল, তার এতদিনের সাধের তারা সাত টুকরাে হয়ে ভেঙে পড়ল। তানে তখন দৌড়ে এসে সেগুলােকে দুহাতে করে ছিটিয়ে দিলেন আর বললেন, এখন থেকে দেখুক সবাই আমার গাছের কত বাহার। দুষ্ট, পরীরা হাে হাে করে হাসতে লাগল।

এখনাে যদি দখিন হাওয়ার দেশে যাও, দেখবে সেই ভাঙা তারার সাতটি টুকরাে আকাশের একই জায়গায় ঝিকমিক করে জলছে। ঘুমের আগে রাজার মেয়ে এখনাে তার ছায়ার সঙ্গে খেলা করে। আর জোছনা রাতে দখিন হাওয়ায় মাতারিকির দীর্ঘনিবাস শােনা যায়।

সন্দেশ-১৩২৩

লােলির পাহারা