Pitara logo

আশ্চর্য ছবি

জাপান দেশে সেকালের এক চাষা ছিল, তার নাম কিকিৎসম। ভারি গরিব চাষা, আর যেমন গরিব তেমনি মুখ। দুনিয়ার সে কোন খবরই জানত না; জানত কেবল চাষবাসের কথা, গ্রামের লােকদের কথা, আর গ্রামের যে বড়াে বজ্ঞে’ (পরােহিত), তার ভালাে ভালাে উপদেশের কথা। চাষার যে স্ত্রী, তার নাম লিলিৎসি। লিলিৎসি চমৎকার ঘরকন্না করে, বাড়ির ভিতর সব তকতকে ঝরঝরে করে গুছিয়ে রাখে, আর রান্না করে এমন সুন্দর যে চাষার মুখে তার প্রশংসা আর ধরে না। কিকিৎসম কেবলই বলে, “এত আমার বয়স হল, এত আমি দেখলাম শুনলাম, কিন্তু রুপে গণে এর মতাে আর-একটি কোথাও দেখতে পাই নি।” লিলিৎসি সে কথা যত শােনে ততই খুশি হয়।

একদিন হয়েছে কি, কোথাকার এক শহরে বড় মানুষ এসেছেন সেই গ্রাম দেখতে; তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর ছােট্ট মেয়েটি, আর মেয়েটির ছিল একটি ছােট্ট আয়না। রাস্তায় চলতে চলতে আয়নাটা সেই মেয়ের হাত থেকে কখন পড়ে গেছে, কেউ তা দেখতে পায় নি। কিকিৎসম যখন চাষ করে বাড়ি ফিরছে তখন সে দেখতে পেল, রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে কি একটা চকচক করছে। সে তুলে দেখল, একটা অদ্ভুত চ্যাপ্টা চৌকোনা জিনিস! সে কিনা কখনাে আয়না দেখে নি, তাই সে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, এটা আবার কিরে? নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ সেই আরসির ভিতরে নিজের ছায়ার দিকে তার নজর পড়ল। সে দেখল কে একজন অচেনা লােক তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে সে এমন চমকে উঠল, যে আর-একট, হলেই আয়নাটা তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে সে ঠিক করল, এটা নিশ্চয়ই আমার বাবার ছবি-দেবতারা আমার উপর খুশি হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার বাবা মারা গিয়েছেন সে অনেক দিনকার কথা, কিন্তু তব, তার মনে হল, হ্যাঁ এইরকমই তাে তাঁর চেহারা ছিল। তারপর কি আশ্চর্য! সে চেয়ে দেখল তার নিজের গলায় যেমন একটা রপার মাদুলি, ছবির গলায়ও ঠিক তেমনি! এ মাদলি তাে তার বাবারই ছিল, তিনি তাে সর্বদাই এটা গলায় দিতেন তবে তাে এটা তার বাবারই ছবি।

তখন কিকিৎসম করল কি, আয়নাটাকে যত্ন করে কাগজ দিয়ে মুড়ে বাড়ি নিয়ে এল। বাড়ি এসে তার ভাবনা হল, ছবিটাকে রাখে কোথায় ? তার স্ত্রীর কাছে যদি রেখে দেয়, তবে সে হয়তাে পাড়ার মেয়েদের কাছে গপ করবে, আর গ্রামস, সবাই এসে ছবি দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়বে। গ্রামের মখগলাে তাে সে ছবির মর্যাদা বুঝবে না, তারা আসবে কেবল ‘তামাশা’ দেখবার জন্য! তা হবে না—তার বাবার ছবি নিয়ে ছেলেবুড়াে সবাই এসে নােংরা হাতে নাড়বে-চাড়বে তা কিছুতেই হতে পারবে না। এ ছবি কাউকে দেখান হবে না, লিলিৎসিকেও তার কথা বলা হবে না।

কিকিৎসম বাড়িতে এসে একটা বহুকালের পরানাে ফলদানির মধ্যে আরসিটাকে লুকিয়ে রাখল। কিন্তু তার মনটা আর কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। খানিকক্ষণ পরে পরেই সে একবার করে দেখে যায় ছবিটা আছে কিনা। তার পরের দিন সে মাঠে কাজ করছে এমন সময় হঠাৎ তার মনে হল, ছবিটা আছে তাে? অমনি সে কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে দেখতে এল। দেখে নিশ্চিত হয়ে বাইরে যাবে, এমন সময় লিলিৎসি সেই ঘরে এসে পড়েছে। লিলিৎসি বলল, “এ কি! তুমি দুপুরবেলায় ফিরে এলে যে? অসখ করে নি তাে?” কিকিৎসম থতমত খেয়ে বলল, “না না, হঠাৎ তােমায় দেখতে ইচ্ছা করল তাই বাড়ি এলাম।’ শনে লিলিৎসি ভারি খুশি হয়ে গেল। তারপর আর-একদিন এইরকম লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি দেখতে এসে কিকিৎসম আবার তার স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ল। সেদিনও সে বলল, “তােমার ঐ সুন্দর মুখখানা বার বার মনে হচ্ছিল, তাই একবার ছুটে দেখতে এলাম।” সেদিন কিন্তু লিলিৎসির মনে একট, কেমন খটকা লাগল। সে ভাবল, ‘কই, এতদিন তাে কাজ করতে করতে একবারও আমায় দেখতে আসে নি, আজকাল এরকম হচ্ছে কেন?’

তারপর আর-একদিন কিকিৎসম এসেছে ছবি দেখতে। সেদিন লিলিৎসি টের পেয়েও দেখা দিল না—চুপিচুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল—কিকিৎসম সেই ফলদানির ভেতর থেকে কি একটা জিনিস বার করে দেখল, তারপর খুব খুশি হয়ে যত্ন করে আবার রেখে দিল। কিকিৎসম চলে যেতেই লিলিৎসি দৌড়ে এসে ফলদানির ভিতর থেকে কাগজে মােড়া আরসিটাকে টেনে বার করল। তারপর তার মধ্যে তাকিয়ে দেখে অতি সুন্দর এক মেয়ের ছবি!

তখন যে তার রাগটা হল—সে রাগে গজ গজ করে বলতে লাগল, “এই জন্যে রােজ বাড়িতে আসা–আবার আমায় বলেন তােমার মুখখানা দেখতে এলাম’, তােমার মতাে সুন্দর আর হয়ই না।’ মাগাে! কি বিশ্রী মেয়েটা! হোঁৎকা মুখ, থ্যবড়া নাক, ট্যারচা চোখ—আবার আমার মতাে করে চুল বাঁধা হয়েছে। দেখ না কিরকম হিংসুটে চেহারা! এই ছবি আবার আদর করে তুলে রেখেছেন—আর রােজ রােজ আহাদ করে দেখতে আসেন।” লিলিৎসির চোখ ফেটে জল আসল,সে মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর চোখ মুছে আর-একবার আরসির দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটার কি ছিচকাদনে চেহারা–এমন চেহারাও কেউ পছন্দ করে!” সে তখন আয়নাকে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল।

সন্ধ্যার সময় কিকিৎসম বাড়ি এসে দেখল, লিলিৎসি মুখ ভার করে মেঝের উপর বসে রয়েছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “কি হয়েছে?” লিলিৎসি বলল, “থাক থাক, আদর দেখাতে হবে না-নাও তােমার সাধের ছবিখানা নাও। ওকে নিয়েই আদর কর, যত্ন কর, মাথায় করে তুলে রাখাে।” তখন কিকিৎসম গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি যে আমার ছবিকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছ—জান ওটা আমার বাবার ছবি ?” লিলিৎসি আরাে রেগে বলল, “হ্যাঁ, তােমার বাবার ছবি! আমি কচি খুকি কিনা, একটা বলে দিলেই হল! তােমার বাবার কি অমনি আহযাদী মেয়ের মতাে চেহারা ছিল? তিনি কি আমাদের মতাে করে খোঁপা বাঁধতেন ?” কথাটা শেষ না হতেই কিকিৎসম বলল, “তুমি না দেখেই রাগ করছ কেন? একবার ভালাে করে দেখই না।” এই বলে কিকিৎসম নিজে আবার দেখল, আরসির মধ্যে সেই মুখ।

তখন দুজনের মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া বেধে গেল। কিকিৎসম বলে ওটা তার বাবার ছবি, লিলিৎসি বলে ওটা একটা হিংসটি মেয়ের ছবি। এইরকম তর্ক চলছে, এমন সময়ে গ্রামের যে বড়াে বজ্ঞে’, সে তাদের গলার আওয়াজ শুনে দেখতে এল ব্যাপারখানা কি! পরতঠাকুরকে দেখে দুজনেই নমস্কার করে তার কাছে নালিশ লাগিয়ে দিল। কিকিৎসম বলল, “দেখুন, আমার বাবার ছবি, সেদিন আমি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেলাম, আর ও কিনা বলে যে ওটা কোন-এক মেয়ের ছবি।” লিলিৎসি বলল, “দেখলেন কি অন্যায়! এনেছেন একটা গোমড়ামুখি মেয়ের ছবি, আর আমায় বােঝাচ্ছেন, ঐ নাকি তাঁর বাবা!”

তখন ‘বজ্ঞে’ ঠাকুর বললেন, “দাও তাে দেখি ছবিখানা।” তিনি আরসি নিয়ে মিনিট পাঁচেক খুব গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আয়নাটাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, “তােমরা ভুল বুঝেছ। এ হচ্ছে অতি প্রাচীন এক মহাপুরুষের ছবি। আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি একজন যে-সে লােক নন। দেখছ না, মুখে কি গম্ভীর তেজ, কিরকম বুদ্ধি আর পাণ্ডিত্য, আর কি সুন্দর প্রশান্ত অমায়িক ভাব। এ ছবিটা তাে এমন করে রাখলে চলবে না; বড় মন্দির গড়ে তার মধ্যে পাথরের বেদি বানিয়ে, তার মধ্যে ছবিখানাকে রাখতে হবে-আর ফলচন্দন ধপধুনাে দিয়ে তার সম্মান করতে হবে।”

এই বলে বজ্ঞে’ ঠাকুর আরসি নিয়ে চলে গেলেন। আর কিকিৎসম আর লিলিৎসি ঝগড়া-টগড়া ভুলে খুশি হয়ে খেতে বসল।

ভাঙা তারা