
দ্বিতীয় উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ! দ্বিতীয় উপাখ্যানের আরম্ভ করি অবধান কর।
যমুনাতীরে, জয়স্থল নামে এক নগর আছে। তথায়, কেশব নামে এক পরম ধার্ম্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। ঐ ব্রাহ্মণের, মধুমালতী নামে এক পরম সুন্দরী দুহিতা ছিল। কালক্রমে, মধুমালতী বিবাহযােগ্য হইলে তাহার পিতা ও ভ্রাতা, উভয়ে উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণে তৎপর ইলেন।
কিয়ৎ দিন পরে, ব্রাহ্মণ, যজমানপুত্রের বিবাহ উপলক্ষে, গ্রামান্তরে গলেন; ব্রাহ্মণের পুত্রও, অধ্যয়নের নিমিত্ত, গুরুগৃহে প্রস্থান চরিলেন। উভয়ের অনুপস্থিতি সময়ে এক সুকুমার ব্রাহ্মণকুমার কেশবের গৃহে অতিথি হইলেন। কেশবের ব্রাহ্মণী, তাহাকে রূপে (তিপতি ও বিদ্যায় বৃহস্পতি দেখিয়া, মনে মনে বাসনা করিলেন, যদি কুলােভ হয় ও অঙ্গীকার করে, তবে ইহাকেই জামাতা করিব; মনন্তর, যথােচিত অতিথিসৎকার করিয়া, তাহার কুলের পরিচয় ইলেন, এবং সৎকুলজাত জানিয়া আনন্দিত হইয়া কহিলেন, বৎস! যদি তুমি স্বীকার কর, তােমার সহিত আমার মধুমালতীর বিবাহ দি।
বিপ্রতনয়, মধুমালতীর লােকাতীত লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, কেশব পত্নীর প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং ব্রাহ্মণের প্রত্যাগমপ্রতীক্ষায়, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।
কতিপয় দিবস অতীত হইলে, ব্রাহ্মণ ও তাঁহার পুত্র উভয়ে, মধু মালতিপ্রদানে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া, এক এক পাত্র লইয়া প্রবাস হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। তিন পাত্ৰ একত্র হইল, একের নাম ত্রিবিক্রম, দ্বিতীয়ের নাম বামন, তৃতীয়ের নাম মধুসূদন। তিন জনই রূপ, গুণ, বিদ্যা, বয়ঃক্রমে তুল্য, কোনও ক্রমে ইতরবিশেষ করিতে পারা যায় না। তখন ব্রাহ্মণ, বিলক্ষণ বিপদগ্রস্ত হইয়া এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, এক কন্যা, তিন পাত্র উপস্থিত, কি উপায় করি; তিন জনেই তিন জনের নিকট প্রতিশ্রুত হইয়াছি; এক্ষণকার কর্তব্য কি।
ব্রাহ্মণ এবম্প্রকার চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে ব্রাহ্মণী আসিয়া কহিলেন, তুমি এখানে বসিয়া কি ভাবিতেছ, সর্পাঘাতে মধুমালতীর প্রাণত্যাগ হয়। তখন কেশবশৰ্মা, সাতিশয় ব্যতিব্যস্ত হইয়া, চারি পাঁচ জন বিষবৈদ্য আনাইয়া, অশেষ প্রকারে চিকিৎসা করাইলেন; কিন্তু কোনও প্রকারেই প্রতীকার দর্শিল না। বিষবৈদ্যেরা কহিল, মহাশয়! আপনকার কন্যাকে কালে দংশন করিয়াছে, এবং বার তিথি, নক্ষত্র, সমুদয়ের দোষ পাইয়াছে; স্বয়ং ধন্যন্তরী উপস্থিত হইলেও, ইহাকে বাঁচাইতে পারিবেন না। এক্ষণকার যাহা কর্তব্য থাকে, করুন; আমরা চলিলাম। এই বলিয়া, প্রণাম করিয়া, বিষবৈদ্যেরা প্রস্থান করিল।
কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, মধুমালতীর প্রাণবিয়ােগ হইল। তখন ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের পুত্র, এবং তিন বর, পাঁচ জন একত্র হইয়া তদীয় মৃত দেহ শ্মশানে লইয়া গিয়া, যথাবিধি দাহক্রিয়া করিলেন। ব্রাহ্মণ, পুত্র সহিত গৃহে আসিয়া, সাতিশয় বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। বরেরা তিন জনেই, এতাদৃশ অলৌকিকরুপনিন ‘কন্যানিধান লাভে হতাশ হইয়া বৈরাগ্য অবলম্বন করিলেন। তষ্যে, ত্রিবিক্রম চিতা হইতে অস্থিরসঞ্চয়ন করিলেন, এবং বস্ত্রখণ্ডে বন্ধন পূর্বক, কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া, দেশে দেশে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন; বামন সন্ন্যাসী হইয়া তীর্থযাত্রা করিলেন; মধুসূদন, সেই শ্মশানের প্রান্ত ভাগে পর্ণশালানিৰ্মাণ করিয়া, তাহার এক কোণে মধুমালতীর রাশীকৃত দেহভস্ম রাখিয়া, যােগসাধন করিতে লাগিলেন।
এক দিন, বামন, ভ্রমণ করিতে করিতে, মধ্যাহ্ন কালে, এক ব্রাহ্মণের আলয়ে উপস্থিত হইলেন। ব্রাহ্মণ, ভােজনকালে সন্ন্যাসী উপস্থিত দেখিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন, মহাশয়। যদি, কৃপা করিয়া, দীনের ভবনে পদার্পণ করিয়াছেন, তবে অনুগ্রহ পূর্বক ভিক্ষাৰীকার করুন; তাহা হইলে, আমি চরিতার্থ হই; পাকের অধিক বিলম্ব নাই। সন্ন্যাসী সম্মত হইলেন এবং পাকান্তে ভােজনে বসিলেন। ব্রাহ্মণী পরিবেশন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, ব্রাহ্মণের পঞ্চমবর্ষীয় পুত্র, নিতান্ত আশান্ত ভাবে উৎপাত আরম্ভ করিয়া, পরিবেশনের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। ব্রাহ্মণী নানা প্রকারে সান্ত্বনা করিলেন; বালক কোনও ক্রমে প্রবােধ মানিলেক না। তখন তিনি, ক্রোধভরে, পুত্রকে প্রজ্বলিতহুতাশনপূর্ণ চুল্লীতে নিক্ষিপ্ত করিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, নির্বিঘ্নে পরিবেশন করিতে লাগিলেন।
সন্নাসী, ব্রাহ্মণীর এইরূপ বিরূপ আচরণ দেখিয়া, নারায়ণ নারায়ণ বলিয়া, তৎক্ষনাৎ ভােজনপাত্র হইতে হস্ত উত্তোলিত করিলেন। ব্রাহ্মণ কহিলেন, মহাশয়। অকস্মাৎ ভােজনে বিরত হইলেন কেন। সন্ন্যাসী কহিলেন, যে স্থানে এরূপ রাক্ষসের ব্যবহার, তথায় কি প্রকারে ভােজন করিতে প্রবৃদ্ধি হয়, বল। ব্রাহ্মণ, ঈষৎ হাস্য করিয়া, তৎক্ষণাৎ গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং সঞ্জীবনী বিদ্যার পুস্তক বহির্গত করিয়া, তন্মধ্য হইতে এক মন্ত্র লইয়া জপ করিতে লাগিলেন। পুত্র, অবিলম্বে প্রাণদান পাইয়া, পূর্ববৎ উৎপাত করিতে আরম্ভ করিল। সন্ন্যাসী, চমৎকৃত হইয়া, ভােজনসমাপন করিলেন, এবং মনে মনে এই আলােচনা করিতে লাগিলেন, এই পুস্তকে মৃতসঞ্জীবন মন্ত্র আছে; ঐ মন্ত্র জানিতে পারিলে, প্রিয়াকে পুনর্জীবিত করিতে পারি। অতএব, যেরূপে হয়, পুস্তক খানি হলগত করিতে হইবেক।
মনে মনে এরূপ কল্পনা করিয়া, সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণকে কহিলেন, অদ্য অপরাহু হইল; অতএব, আর স্থানান্তরে না গিয়া, তােমার আলয়েই রাত্রিকাল অতিবাহিত করিব। গৃহস্থ ব্রাহ্মণ, পরম সমাদর পূর্বক, স্বতন্ত্র স্থান নিদিষ্ট করিয়া দিলেন। রজনী উপস্থিত হইল। সমুদয় গৃহস্থ ভােজনাবসানে, স্ব স্ব নির্দিষ্ট স্থানে শয়ন করিল। সকলে নিদ্রাভিভূত হইলে, বামন, নিঃশব্দপদসঞ্চারে গৃহে প্রবেশ পূর্বক, সঞ্জীবনী বিদ্যার পুস্তক হস্তগত করিয়া, প্রস্থান করিলেন, এবং অল্প দিনের মধ্যেই, জয়স্থলের শ্মশানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মধুসূদন, স্বহস্তনির্মিত পর্ণকুটীরে অবস্থিত হইয়া, যােগসাধন করিতেছেন। এই সময়ে, দৈবযােগে, ত্রিবিক্রমও তথায় উপস্থিত হইলেন।
এইরূপে তিন বর একত্র হইলে পর, বামন কহিলেন, আমি মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিখিয়াছি; তােমারা অস্থি ও ভস্ম একত্র কর, আমি প্রিয়াকে প্রাণদান দিব। তাঁহারা, মহাব্যস্ত হইয়া, অস্থি ও ভস্ম একত্র করিলেন। বামন, পুস্তক হইতে মৃতসঞ্জীবন মন্ত্র বহিষ্কৃত করিয়া, জপ করিতে লাগিলেন। মন্ত্রের প্রভাবে অনতিবিলম্বে, কন্যার কলেবরে মাংস শােণিত প্রভৃতির আবিষ্কার ও প্রাণ সঞ্চার হইল। তখন তিন জমে, মধুমালতির রূপ ও লাবণ্যের মাধুরী দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, এই কামিনী আমার আমার বলিয়া, পরস্পর বিবাদ করিতে লাগিলেন।
ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। এই তিনের মধ্যে, কোন ব্যক্তি মধুমালতীর পাণিগ্রহণে যথার্থ অধিকারী হইতে পারে। রাজা কহিলেন, যে ব্যক্তি কুটারনির্মাণ করিয়া, এতাবৎ কাল পর্যন্ত, শশানবাসী হইয়াছিল, আমার বিবেচনায়, সেই এই কামিনীর প্রাণিগ্রহণে অধিকারী। বেতাল কহিল, যদি ত্রিবিক্রম অস্থিসঞ্চয়ন করিয়া না রাখিত, এবং বামন, নানা দেশ ভ্রমণ করিয়া, সঞ্জীবনী বিদ্যার সংগ্রহ করিতে না পারি, তবে কি প্রকারে মধুমালতী, প্রাণদান পাইত। রাজা কহিলেন যাহা, কহিচ্ছে, উহা সর্বাংশে সত্য বটে; কিন্তু ত্রিবিক্রম, অস্থিসঞ্চন ঘরা, মধুমালতীর পুত্রস্থানীয়, আর বামন, জীবনদান দ্বারা, পিতৃস্থানীয় হইয়াছে; সুজাং, তাহারা উহার প্রণয়ভাজন হইতে পারে না। কিন্তু মধুসূদন, ভস্মরাশিসংগ্রহ ও উজনিৰ্মাণ পূৰ্ব্বক, শুশানবাসী হইয়া, যথার্থ প্রণয়ীর কাৰ্য্য করিয়াছে। অতএব’ সেই, স্যায়মার্গ অনুসারে, এই প্রমদার প্রণয়ভাজন হইতে পারে।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।