
কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা
(১)
এক রাজপুত্র আর এক রাখাল, দুইজনে বন্ধু। রাজপুত্র প্রতিজ্ঞা করিলেন, যখন তিনি রাজা হইবেন, রাখাল বন্ধুকে তাঁহার মন্ত্রী করিবেন। রাখাল বলিল,ーআচ্ছা।”
দুইজনে মনের সুখে থাকেন। রাখাল মাঠে গরু চরাই আসে, দুই বন্ধুতে গলাগলি হইয়া গাছতলে বসেন। রাখাল বাঁশি বাজায়, রাজপুত্র শােনেন। এইরূপে দিন যায়।
(২)
রাজপুত্র রাজা হইলেন। রাজা রাজপুত্রের কাঞ্চনমালা রাণী, ভাণ্ডার ভরা মানিক,ーকোথাকার রাখাল, সে আবার বন্ধু! রাজপুত্রের রাখালের কথা মনেই রহিল না। একদিন রাখাল আসিযা রাজদুয়ারে ধর্ণা দিলー”বন্ধু রাণী কেমন, দেখাইল না।” দুয়ারী তাঁহাকে “দূর, দূর” করিযা খেদাইয়া দিল। মনের কষ্টে রাখাল কোথায় গেল, কেহই জানিল না।
(৩)
পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়া রাজা চোখ মেলিতে পারেন না। কি হইল, কি হইল?ーরাণী দেখেন, সকলে দেখে, রাজার মুখময় সুঁচーমাথার চুল পর্যন্ত সুঁচ হইয়া গিয়াছে,ーএ কি হইল! রাজপুরীতে কান্নাকাটি পড়িল। রাজা খাইতে পারেন না, শুইতে পারেন না, কথা কহিতে পারেন না। রাজা মনে মনে বুঝিলেন, রাখালーবন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিযাছি, সেই পাপে এ দশা হইল। কিন্তু মনের কথা কাহাকেও বলিতে পারেন না। সুঁচরাজার রাজসংসার অচল হইল,ー“সুঁচরাজা মনের দুঃখে-কষ্টে মাথা নামাইয়া বসিয়া থাকেন; রাণী কাঞ্চনমালা দুঃখে-কষ্টে কোন রকমে রাজত্ব চালাইতে লাগিলেন।
(৪)
একদিন রাণী নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিযাছেন, কাহার এক পরমাসুন্দরী মেয়ে আসিয়া বলিল,ー”রাণী যদি দাসী কিনেন, তাে, আমি দাসী হইব।” রাণী বলিলেনー”সুঁচরাজার সুঁচ খুলিয়া দিতে পার তাে আমি দাসী কিনি।” দাসী স্বীকার করিল। তখণ রাণী হাতের কাঁকন দিয়া দাসী কিনিলেন। দাসী বলিল,ー”রাণী মা, তুমি বড় কাহিল হইয়াছ; কতদিন না-জানি ভাল করিয়া খাও না, নাও না। গায়ের গহনা ঢিলা হইয়াছে, মাথার চুল জটা দিয়াছে। তুমি গহনা খুলিয়া রাখ, বেশ করিয়া ক্ষার -খৈল দিয়া স্নান করাইয়া দেই।”
রাণী বলিলেন, “না মা, কি আর স্নান করিব,ーথাক।”
দাসী তাহা শুনিল না;ー”মা, এখন ডুব দাও।”
রাণী গলাーজলে নামিয়া ডুব দিলেন। দাসী চক্ষের পলকে রাণীর কাপড় পরিয়া, রাণীর গহনা গায়ে দিয়া ঘাটের উপর উঠিয়া ডাকিল
“দাসী লাে দাসী পান্ কৌ।
ঘাটের উপর রাঙ্গা বৌ!
রাঙ্গার রাণী কাঁকনমালা;
ডুব দিবি আর কত বেলা?”
রাণী ডুব দিয়া দেখিলেন, দাসী রাণী হইযাছে, তিনি বাঁদী হইযাছেন। রাণী কপালে চড় মারিয়া, ভিজা চুলে কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁকনমালার সঙ্গে চলিলেন।
(৫)
রাজপুরীতে গিয়া কাঁকনমালা পুরী মাথায় করিল। মন্ত্রীকে বলে,ー”আমি নাইয়া আসিতেছি, হাতি ঘােড়া সাজাও নাই কেন? “ পাত্রকে বলে,ー”আমি নাইয়া আসিব, দোল-চৌদোলা পাঠাও নাই কেন?” মন্ত্রীর, পাত্রের গর্দান গেল। সকলে চমকিল, এ আবার কি! ーভয়ে কেহ কিছু বলিতে পারিল না। কাঁকনমালা রাণী হইয়া বসিল, কাঞ্চনমালা দাসী হইয়া রহিলেন! রাজা। কিছুই জানিতে পারিলেন না।
(৬)
কাঞ্চনমালা আঁস্তাকুড়ে বসিয়া মাছ কোটেন আর কাঁদেন,ー
“হাতের কাঁকন দিয়া কিনলাম দাসী,
সেই হইল রাণী, আমি হইলাম বাঁদী।
কি বা পাপে সােনার রাজার রাজ্য গেল ছার
কি বা পাপে ভাঙ্গিল কপাল কাঞ্চনমালার?”
রাণী কাঁদেন আর চোখের জলে ভাসেন। রাজার কষ্টের সীমা নাই। গায়ে মাছি ভিনভিন্ সূঁচের জ্বালায় গা-মুখ চিনচিন, কে বাতাস করে, কে বা ওষুধ দেয়!
(৭)
একদিন ক্ষার-কাপড় ধুইতে কাঞ্চনমালা নদীর ঘাটে গিয়াছেন। দেখিলেন, একজন মানুষ একরাশ সুতা লইযা গাছতলায় বসিয়া বসিয়া বলিতেছে,
“পাই এক হাজার সূঁচ
তবে খাই তরমুজ!
সঁচ পেতাম পাঁচ হাজার,
তবে যেতাম হাট-বাজার!
যদি পাই লাখ তবে দেই রাজ্যপাট!”
রাণী, শুনিয়া আস্তে আস্তে গিয়া বলিলেন, “কে বাছা সূঁচ চাও, আমি দিতে পারি! তা সূঁচ কি তুমি তুলিতে পারিবে?”। শুনিয়া, মানুষটা চুপ-চাপ সুতার পুঁটলি তুলিয়া রাণীর সঙ্গে চলিল।
(৮)
পথে যাইতে যাইতে কাঞ্চনমালা, মানুষটির কাছে আপনার দুঃখের কথা সব বলিলেন। শুনিয়া, মানুষ বলিল,ー”আচ্ছা! “
রাজপুরীতে গিয়া মানুষ রাণীকে বলিল,ー”রাণীমা, রাণীমা, আজ পিট-কুডুলির ব্রত, রাজ্যে পিটা বিলাইতে হয়। আমি লালসুতা নীলসুতা রাঙাইয়া দি, আপনি গে’ আঙ্গিনায় আল্পনা দিয়া পিড়ি সাজাইযা দেন; ও দাসী। মানুষ যােগাড়ーযাগাড় দিক?”
রাণী আহলাদে আটখানা হইয়া বলিলেন,ー”তা’ কেন, হইলーহইল দাসী, দাসীও আজ পিঠা করুক।” তখন রাণী আর দাসী দুইজনেই পিঠা করিতে গেলেন। ও মা! রাণী যে, পিঠা করিলেন,ーআস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা! দাসী, চন্দ্রপুরী, মােহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এই সব পিঠা করিয়াছেন। মানুষ বুঝিল যে, কে রাণী কে দাসী। পিঠে-সিটে করিয়া, দুইজনে আলপনা দিতে গেলেন। রাণী, একমন চাঁল বাটি সাত কলস জলে শুলিয়া এ-ই এক গােছা শনের নুড়ি ডুবাইয়া, সারা আঙ্গিনা লেপিতে বসিলেন। এখানে এক খাবল দেন, ওখানে এক খাবল দেন। দাসী আঙ্গিনার এক কোণে একটু ঝাড়-ঝুড় দিযা পরিস্কার করিয়া একটু চালের গুঁড়ায় খানিকটা জল মিশাইযা, এতটুকু নেকড়া ভিজাইয়া, আস্তে আস্তে পদ্ম-লতা আঁকিলেন, পদ্ম-লতার পাশে সােনার সাত কলস আঁকিলেন; কলসের উপর চুড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া আঁকিয়া, ময়ূর, পুতুল, মা-লক্ষীর সােনা পায়ের দাগ, এই সব আঁকিযা দিলেন। তখন মানুষ কাঁকনমালাকে ডাকিয়া বলিল,ー”ও বাঁদি! এই মুখে রাণী হইছিস?
হাতে কাঁকনের নাগন দাসী!
সেই হইল রাণী, রাণী হইলেন দাসী!
ভাল চাহিস তাে, স্বরূপ কথা-কে।”
কাঁকনমালার গায়ে আগুনে হল্কা পড়িল। কাঁকনমালা গর্জিয়া উঠিয়া বলিল, “কে রে পােড়ারমুখাে দূর হ’বি তাে হ’।” জল্লাদকে ডাকিয়া বলিল,ー”দাসীর আর ঐ নির্বংশে’র গর্দান নাও; ওদের রক্ত দিয়া আমি স্নান করিব, তবে আমার নাম কাঁকনমালা।”
জল্লাদ গিয়া দাসী আর মানুষকে ধরিল। তখন মানুষটা পুঁটলী খুরিয়া বলিল,
“সুতন সুতন নটখটি!
রাজার রাজ্যে ঘটমটি
সুতন সুতন নেবাের পাে,
জল্লাদকে বেঁধে থাে। “
এক গােছা সূতা গিয়া জল্লাদকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া থুইল। মানুষটা আবার বলিল,ー
“সুতন্ তুমি কার?ー
সুতা বলিল,ー”পুঁটলী যার তার।”
মানুষ বলিল,ー”যদি সুতন আমার খাও।
কাঁকনমালার নাকে যাও।”
সুতাের দুই গুটি গিয়া কাঁকনমালার নাকে ঢিবি হইযা বসিল। কাঁকনমালা ব্যস্তে, মস্তে ঘরে উঠিয়া বলিতে লাগিল,ー”দুঁয়ার দাঁও, পুঁয়ার দাঁও, এটা পাঁগন, দাসী পাঁগন নিয়া আঁসিয়াছে।”
পাগল তখন মন্ত্র পড়িতেছেー
“সুতন্ সুতন্ সরুলি, কোন্ দেশে ঘর?
সূঁচ রাজার কুঁচে গিয়ে আপনি পর।”
দেখিতে-না-দেখিতে হিল্হিল্ করিয়া লাখ সুতা রাজার গায়ের লাখ সূঁচে পারিযা গেল। তখন সূঁচেরা বলিল,ー
“সুতার পরাণ সীলি সীলি, কোন ফুড়ন দি৷” মানুষ বলিল,
“নাগন্ দাসী কাঁকনমালার চোখ-মুখটি।”
রাজার গায়ের লাখ সুঁচ উঠিয়া গেল, লাখ সুঁচে কাঁকনমালার চোখ-মুখ সিলাই করিয়া রহিল। কাঁকনমালার যে ছটফটি! রাজা চক্ষু চাহিয়া দেখেন,ーরাখাল বন্ধু! রাজায় রাখালে কোলাকুলি করিলেন। রাজার চোখের জলে রাখাল ভাসিল, রাখালের চোখের জলে রাজ্য ভাসিলেন। রাজা বলিলেন,ー”বন্ধু আমার দোষ দিও না, শত জন্ম তপস্যা করিয়াও তােমার মত বন্ধু পাইব না। আজ হইতে তুমি আমার মন্ত্রী। তােমাকে। ছাড়িযা আমি কত কষ্ট পাইলাম;ーআর ছাড়িব না।”
রাখাল বলিল,ー”আচ্ছা! তা তােমার সেই বাঁশিটি যে হারাইয়া ফেলিয়াছি; একটি বাঁশি দিতে হইবে!’ রাজা রাখাল-বন্ধুকে সােনার বাঁশি তৈরী করাইয়া দিলেন। তাহার পর সূঁচের জ্বালায় দিন-রাত ছটফট করিয়া কাঁকনমালা মরিয়া গেল!
কাঞ্চনমালা দুঃখ ঘুচিল। তখন রাখাল সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করেন, রাত্রে চাঁদের আলােতে আকাশ ভরিয়া গেলে, রাজাকে লইয়া গিয়া নদীর সেই গাছের তলায় বসিয়া বাঁশি বাজান। রাজা গলাগলি করিয়া মন্ত্রী-বন্ধুর বাঁশি শােনেন। রাজা, রাখাল আর কাঞ্চনমালার সুখে দিন যাইতে লাগিল।