
ক্ষীরের পুতুল - তৃতীয় অধ্যায়
রাজমন্ত্রী রাজসিংহাসনের এক পাশে, রাজ্যের মাঠ-ঘাট দোকানপাট সন্ধান করে, যাদুকরের দেশের এক বণিকের জাহাজ থেকে, কানা-কড়ি দিয়ে একটি বাঁদরছানা কিনে বসে আছেন।
রাজা এসে বললেন মন্ত্রীবর, আশ্চর্য হলুম! মাপ দিয়ে ছোটোরানীর গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, সে শাড়ি, সে গহনা, রানীর গায়ে হল না!
তখন সেই বনের বানর রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে-বড়াে ভাগ্যবতী পুণ্যবতী না হলে দেবকন্যের হাতে বােনা, নাগকন্যের হাতে গাঁথা, মায়া-রাজ্যের এ মায়া-গহনা, মায়া-শাড়ি পরতে পায় না।
মহারাজ, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ, যাকে বৌ করবে তাকে পরতে দিও।
বানরের কথায় রাজা অবাক হলেন। হাসতে হাসতে মন্ত্রীকে বললেন মন্ত্রী বানরটা বলে কি? ছেলেই হল না, বৌ আনব কেমন করে? মন্ত্রী, তুমি স্যাকরাব দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়তে দাওগে, তাতির তাতে রানীর শাড়ি বুনতে দাওগে। এ গহনা, এ শাড়ি, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ; যদি বৌ ঘরে আনি তাকে পরতে দেব। রাজমন্ত্রী স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়াতে গেলেন। আর, রাজা সেই বাঁদর-কোলে বড়ােরানীর কাছে গেলেন। দুঃখিনী বড়ােরানী, জীর্ণ আঁচিলে পা মুছিয়ে, ভাঙা ঘরে ছেড়া কাঁথায় রাজাকে বসতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— মহারাজ, বােসো। আমার এই ভাঙা ঘরে ছেড়া কাঁথায় বােসো। আমার আর কী আছে তােমায় বসতে দেব? হায়, মহারাজ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে, আমি এমনি অভাগিনী তােমার জন্যে ছেড়া কাঁথা পেতে দিলুম।
রানীর কথায় রাজার চোখে জল এল। ভাঙা ঘরে ছেড়া কাঁথায় বসে বড়ােবানীর কোলে বাদর-ছানা দিয়ে বললেন- মহারানী, তােমার এ ছেড়া কাঁথা ভাঙা ঘর, ছোটোরানীর সােনার সিংহাসন, সােনার ঘরের চেয়ে লক্ষগুণে ভালো। তোমার এ ভাঙা ঘরে আদর আছে, যত্ন আছে, দুটো মিষ্টি কথা আছে; সেখানে তা তাে নেই। রানী, সাত জাহাজ সােনা দিয়ে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি দিয়েছি, ছোটোরানী পায়ে ঠেলেছে; আর কানাকড়ি দিয়ে তােমার বাঁদর এনেছি, তুমি আদর করে কোলে নিয়েছ। রানী, আমি আর তােমায় দুঃখ দেব না। এখন বিদায় দাও, আমি আবার আসব রানী। কিন্তু দেখাে, ছোটোরানী যেন জানতে না-পারে! তােমার কাছে এসেছি শুনলে আর রক্ষে রাখবে না! হয় তােমায়, নয়তাে আমায়, বিষ খাওয়াবে।
এমনি করে রাত কাটল। ছােটোরানীর সােনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, রাজার পাশে রাত কাটল; আর বড়োরানীর জলে ঝড়ে, ভাঙা ঘরে, ছেড়া কাঁথায় রাত কাটল।
সকাল হল। রাজবাড়িতে প্রহরীখানায় প্রহর বাজল, নাকরাখানায় নবৎ বাজল, রাজারানীর ঘুম ভাঙল। রাজা সােনার ভৃঙ্গারে স্ফটিকজলে মুখ ধুয়ে, রাজবেশ অঙ্গে পরে, রাজ-দরবারে নেবে গেলেন। আর ছােটোরানী সােনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, ফুলের পাখায় হাওয়া খেতে খেতে পাশ ফিরে ঘুম গেলেন।
আর বড়ােরানী কী করলেন?
ভাঙা ঘরে সােনার রোদ মুখে পড়ল, রানী উঠে বসলেন। এদিক দেখলেন ওদিক দেখলেন, এপাশ দেখলেন, ওপাশ দেখলেন– বানর নেই! রানী এ-ঘর খুঁজলেন ও-ঘর খুজলেন ঘরের চাল খুঁজলেন, গাছের ডাল খুঁজলেন – বানর নেই। বড়ােরানী কাঁদতে লাগলেন।
বানর কোথা গেল?
বানর ভাঙা ঘরে ঘুমন্ত রানীকে একলা রেখে রাত না-পােহাতে রাজ-দরবারে চলে গেল।রাজা বার দিয়ে দরবারে বসেছেন। চারিদিকে সভাসদ মন্ত্রী, দুয়ারে সিপাই-সান্ত্রী, আশে-পাশে লােকের ভিড়। রানীর বানর সেই লােকের ভিড় ঠেলে, সিপাই-সান্ত্ৰর হাত এড়িয়ে, রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে- মহারাজ, বড়াে সুখবর এনেছি, মায়ের আমার ছেলে হবে।
রাজা বললেন- ওরে বানর বলিস কী? এ কথা কি সত্য? বড়ােরানী দুওরানী তার ছেলে হবে? দেখিস এ কথা যদি মিথ্যা হয় তো তােকেও কাটব আর তাের মা দুওরানীকেও কাটব।
বানর বললে- মহারাজ, সে ভাবনা আমার। এখন আমায় খুশি কর, আমি বিদায় হই।। রাজা গলার গজমােতি হার খুলে দিয়ে বানরকে বিদায় করলেন।
বানর নাচতে নাচতে ভাঙা ঘরে দুওরানী পড়ে পড়ে কাঁদছেন সেখানে গেল।
দুওরানীর চোখের জল, গায়ের ধুলাে মুছিয়ে বানর বললে– এই দেখ, মা, তাের জন্যে কী এনেছি! তুই রাজার রানী, গলায় দিতে হার পাসনে, কাঠের মালা কিনে পরিস, এই মুক্তোর মালা পর।
রানী বানরের হাতে গজমােতি হার দেখে বললেন— এই হার তুই কোথা পেলি? এ যে রাজার গলার গজমােতি হার! যখন রানী ছিলুম রাজার জন্যে গেঁথেছিলুম, তুই এ হার কোথা পেলি? বল বানর, রাজা কি এ হার ফেলে দিয়েছেন, রাজপথে কি কুড়িয়ে পেলি?
বানর বললে- না মা, কুড়িয়ে পাইনি। তাের হাতে গাথা রাজার গলার গজমােতি হার কুড়িয়ে কি পাওয়া যায় ?
রানী বললেন- তবে কি রাজার ঘরে চুরি করলি?
বানর বললে– ছি ছি মা, চুরি কি করতে আছে! আজ রাজাকে সু-খবর দিয়েছি তাই রাজা হার দিয়ে খুশি করেছেন।
রানী বললেন- ওরে বাছা, তুই যে দুঃখীর সন্তান, বনের বানর! ভাঙা ঘরে দুঃখিনীর কোলে শুয়ে, রাজাকে দিতে কি সুখের সন্ধান পেলি যে রাত না-পােহাতে রাজবাড়িতে ছুটে গেলি?
বানর বললে মা আমি স্বপ্ন পেয়েছি আমার যেন ভাই হয়েছে, তাের কোলে খােকা হয়েছে; সেই খােকা যেন রাজসিংহাসনে রাজা হয়েছে। তাই ছুটে রাজাকে খবর দিলুম- রাজামহাশয়, মায়ের খােকা হবে। তাইতে রাজা খুশি হয়ে গলার হার খুলে দিলেন।
রানী বললেন- ওরে, রাজা আজ শুনলেন ছেলে হবে, কাল শুনবেন মিছে কথা! আজ রাজা গলায় দিতে হার দিলেন কাল যে মাথা নিতে হুকুম দেবেন! হায় হায়, কী করলি? একমুঠো খেতে পাই, একপাশে পড়ে থাকি, তবু বছর গেলে রাজার দেখা পাই, তুই আমার তাও ঘােচালি? ওরে তুই কী সর্বনাশ করলি? মিছে খবর কেন টালি? এ জঞ্জাল কেন ঘটালি?
বানর বললে মা তাের ভয় কী, ভাবিস কেন? এ দশমাস চুপ করে থাক্, সবাই জানুক বড়রানীর ছেলে হবে। তারপর রাজা যখন ছেলে দেখবেন তখন তোর কোলে সােনার চাঁদ ছেলে দেব, তুই রাজাকে দেখাস। এখন চল, বেলা হল, খিদে পেয়েছে।
রানী বললেন— চল বাছা চল। বাটি পুরে জল রেখেছি, গাছের ফল এনেছি, খাবি চল। রানী ভাঙা পিড়েয় বানরকে খাওয়াতে বসলেন। আর রাজা ছােটোরানীর ঘরে গেলেন।